বৃহস্পতিবার - এপ্রিল ২৫ - ২০২৪

যে মানুষ চলে গেল সুতোর ওপারে

কবি রফিক আজাদ

অবিচ্যুয়ারি লেখা কঠিন একটি কাজ, বিশেষ করে অতি কাছের কেউ একজন এমন করে সহসা চলে গেলে। এমন করে অনন্তকালের জন্যে চোখের আড়াল হলে, মিশে গেলে নক্ষত্রালোকে। ভাবতেই কেমন যেন একটা হীম ধরা অন্ধকার রাত এসে জড়িয়ে ধরে। মনে হয়, যেন তিনি নন, আমিই শুয়ে আছি অই গাঢ় অন্ধকারে, মৃত্যুর হীমঘরে।
বারো হাজার মাইল দূর থেকে প্রিয়বন্ধু, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ফোনটা যখন এলো রাত এখানে তিনটে তখন। বললেন, রফিক ভাই চলে গেছেন একটু আগে। তো ভাবলাম, ফোন করে আপনাকে খবরটা দেই।
মানুষের জীবনে মৃত্যু অবিশ্বাস্য কোন ঘটনা নয়, অস্বাভাবিক তো নয়ই। তবু কেন যেন কোন কোন মৃত্যু হয়ে ওঠে অস্বাভবিক, মনে হয় অবিশ্বাস্য। মানা যায় না। ভিজে ওঠে চোখের পাতা, চোখ ভেসে যায় জলে।
মাত্র কিছুদিন আগেও টরন্টোতে শহিদুল ইসলাম মিন্টু ও জসিম মল্লিককে নিয়ে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম কবিপুত্র অভিন্ন ও অব্যয় আজাদদের হারবার ফ্রন্টের এপার্টমেন্টে। তাঁকে বেশ সুস্থই মনে হয়েছিল আমার। অন্তত বাইরের থেকে দেখে। আসলে তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন ভিতরে ভিতরে। যথেষ্ট দূর্বল হয়ে গেছেন। তবে তা আমলে আনছেন না মোটেই। বললেন, আমাকে ঢাকা যেতে হবে। অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। শেষ করতে হবে। বললেন, আত্মজীবনীর কথা।
উন্নত চিকিৎসার জন্য টরন্টোতে অন্তত একটি বছর আমি তাঁর থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বললে তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন বলে মনে হ’ল। বললেন, আমি ভালো আছি। এই বয়সে অমন এক আধটু অসুখবিসুখ সকলেরই হয়। ও নিয়ে বিচলিত হবার কিছু নেই।
ভাবী ( কবি দিলারা হাফিজ ) বললেন, ও বাংলাদেশে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। এক বছর তো দূরের কথা, একমাসও থাকতে চাইছে না।
রফিক ভাই টরন্টোতে ছিলেন আরো মাসখানেক। দু’একটি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহন করেছিলেন। একদিন ফোন করতেই বললেন, আমরা সবাই একটু পড়েই যাচ্ছি মেক্সিকো, মায়া রিভেয়েরা। এলে দেখা করো। ফোন দিও।
শুনে খুশি হলাম আমি, মনে মনে বললাম, ভালো তো।
মৃত্যুর খবরটা শুনে পরদিন কবি শহীদ কাদরীকে ফোন করতেই তিনি বলে উঠলেন, সব কিছু তো শেষ হয়ে গেল ইকবাল। আমরা তো কাউকেই আর ধরে রাখতে পারছি না। সিকদার চলে গেল, মান্নান চলে গেল, শামসুল ইসলাম, অরুনাভ চলে গেল; রফিক ছিলÑ ও চলে গেল। এক একটি বাড়ি যেন ভেঙে পড়ছে। রফিকের মৃত্যু আমি কিছুতেই মানতে পারছি না, কিছুতেই না।
আর্দ্র ও ভারী হয়ে উঠলো তাঁর কন্ঠস্বর, বললেন, জানো রফিক অসুস্থ শরীর নিয়েও আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য নিউইয়র্ক এসে ছিল এই হাড়কাঁপা শীতের ভিতরে। কয়েকযুগ পর এক জমপেশ আড্ডা হয়েছিল আমাদের। তবে
বেশীক্ষন থাকেনি। যাবার সময় বলে গেল, পরে আবার সময় নিয়ে আসবে। আর তো কোনদিন রফিক কে দেখতে পাবো না।
হা, রফিক ভাইয়ের সঙ্গে শেষ যেদিন কথা হয়, বলেছিলেন, ওস্তাদের সঙ্গে দেখা কইরা আইলাম। তোমরা মিয়া খালি অসুখ অসুখ করো।
তারপর তাঁর সেই চিরাচরিত কৌতুক, বললেন, তোমার শরীরের যে সিচ্যুয়েশন তারচে’ শহীদ তো ডায়ালিসিস নিয়াও ভালো আছে। অই মুহূর্তে তাঁর মুখের শিশুসুলভ হাসিটি যেন আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম।

বেদনার কথা এই যে, আমাদের কেউ কি কোনদিন ভেবেছে, এই আমাদের শেষ দেখা! এই দিনটি আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আর এই হবে যদি জানতাম, তাহলে তো আরো কিছুটা সময় রফিক ভাইয়ের সান্নিধ্যে কাটাতে পারতাম।
রিটনের ফোন রাখতে না রাখতেই বিষাদ যেন শানিত হয়ে উঠলো ষ্টেইনলেস বেøডের ধারালো চোখের মতো।
আর নির্ঘুম রাতের অন্ধকারে যেন ঝাকে ঝাকে নেমে এলো স্মৃতির জোনাকীরা।

- Advertisement -

২.
তখন গরমকাল।
মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে আর তারপরও ফ্যানের বেøডের নীচে আমি বেশ গরম। ইত্তেফাক সাময়িকী’তে আমার একটি কবিতা বেরিয়েছে এই আনন্দে। কবিতার নাম, শীত।
ফোন এলো, অপরপ্রান্তে রফিক আজাদ। তিনি তখন সাপ্তাহিক রোববার এর দায়ীত্বে। বললেন, বেটা উপরে আসো।
ইত্তেফাক ভবনের চারতলায় রফিক ভাই, দোতলায় আমি। মাঝেরতলায় ইত্তেফাক এর একাউন্টস্, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন সেকশন।
এক্ষুনি আসোÑ চা শীতল হয়ে যাচ্ছে।
আমি উপরে যাচ্ছি হন্তদন্ত হয়ে, রাহাত ভাই ( শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক, দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক রাহাত খান ) পায়চারি করছিলেন বারান্দায়, ডানহাতের দু’আঙুল শূন্যে ঘুরিয়ে বললেন, আরে অতো হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছো ? বললাম, রফিক ভাই চা খেতে ডেকেছেন। তারপর প্রায় দৌড়।
এসে দেখি, চেয়ারে হাটু তুলে একটা চাদর গায়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছেন রফিক ভাই। টেবলে চায়ের কাপ।
এই গরমে তাঁকে চাদর জড়িয়ে বসে থাকতে দেখে তো আমি অবাক।
চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে বললাম, আপনি এই গরমে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছেন কেন?
আর বোলো না। কাল ইত্তেফাক এ শীত নামে তোমার কবিতাটি পড়ে এমন ঠান্ডা লাগলো যে, চাদর শরীর থেকে আর নামতেই চায় না।
বলেই মুখে সেই শিশুসুলভ হাসি। আমি রাগতে গিয়েও হেসে ফেললাম। রফিক ভাই বললেন, তোমার সঙ্গে একটু কৌতুক করলাম। সবাই তো আর কৌতুক সহজভাবে নিতে পারে না।
আর একদিন তাঁর রুমে গিয়ে দেখি, তিনি বসে আছেন, একা। তাঁর হাত ভেজা।
তাঁর হাত এতো ঘামছে দেখে আমি অবাক, বললাম, রফিক ভাই আপনার হাত এভাবে ঘামছে কেন?
ঘামছে না। চোখের পানিতে হাত ভিজে গেছে।
চোখের পানি মানে ? কার চোখের পানি, কোত্থেকে এলো?
তোমাদের এই ভবনের এক কবির কবিতা পড়তে না পড়তেই তার চোখের পানিতে হাত ভিজে গেল। ওর কবিতায় তো কান্নাকাটি ছাড়া আর কিছুই থাকে না !
তাঁর নির্মেদ সারল্যেভরা কৌতুক থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব প্রায়। একান্ত কাছের বন্ধুদের নিয়েও বলতেন, তাঁর প্রিয় একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক কে ডাকতেন ‘সূত্রাপুরের কাফ্কা’ বলে। প্রিয় বন্ধু কবিকে বলতেন, ‘কাঠালবাগানের স্যুররিয়ালিষ্ট’। এসবে তাঁদের বন্ধুত্বে চির ধরেনি কোনোদিন।

৩.
যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো জীবনের ভুলগুলি।
যদি ভালোবাসা পাই শিল্প-দীর্ঘ পথে বয়ে যাবো কাঁথাগুলি।
শিল্প-দীর্ঘ পথে শ্বাশ্বত সুন্দর জীবনের স্বপ্নে এ যেন এক অনন্ত যাত্রা কবি রফিক আজাদের।
আজো ভুলতে পারিনি ষাটের স¤্রাটের সেই অবিনাশী প্রেমময় উচ্চারন। রাগী জেদী রফিক আজাদ কবিতায় যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল উপমা উৎপ্রেক্ষা আর চিত্রকল্পে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা। ষাটের দশক’কে আমরা বলি বাংলা কবিতার বাক পরিবর্তনের দশক। ষাটের অপর পুরোধা প্রকৃত-পরাবাস্তব কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের পাশাপাশি রফিক আজাদের কবিতার ধ্রূপদী বিন্যাস ও প্রতীকী-ধর্ম বাংলা কবিতায় তৈরি করেছিল ভিন্ন মাত্রার ক্লাসিক অবয়ব। অনেকটাই যেন সুধীন দত্ত ঘরানার। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিনের বৃত্তের বাইরে তিনি নির্মাণ করেছেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আশ্চর্য সুন্দর এক ইন্দ্রজালিক কাব্যজগত। তাঁর পরিভ্রমন যেন ভিন্ন কোনো কক্ষপথে। নিজের পরিভ্রমনের এই একান্ত নিজস্ব কক্ষপথটি তিনিই নির্মাণ করেছিলেন কাব্যজীবনের সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে।
রফিক আজাদের হাতে প্রেম-প্রতিমার যে প্রতিকৃতি আমরা দেখি, তা কেবলি দেহজ নয়- তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজ-সংসার, প্রকৃতি। যেন তিনি দায়বদ্ধ এই সমাজ-সংসার, প্রেম ও প্রকৃতির কাছে। প্রেমের পবিত্র আলোকের ভিতরও আমরা দেখি যুদ্ধ, ক্ষরা, ধ্বংস, ক্ষয়, মহামারি, মৃত্যু আর পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী আঁচরের ভয়ংকর বেদনাময় দৃশ্যচিত্র। তিনি চিৎকার করে ওঠেনÑ
ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে’ হারামজাদা, তা না হ’লে মানচিত্র খাবো।

ইস্টইয়র্ক, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent