শুক্রবার - এপ্রিল ২৬ - ২০২৪

কানাডার কনফেডারেশন সেতু

ছবিকনফেডারেশন ব্রীজ ডটকম

ছয় দশমিক এক পাঁচ কিলোমিটার পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।এবার কেবল শক্ত কাঁধে ভার বইবার অপেক্ষা। বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এবংহাজার হাজার নির্মাণ কর্মী সেতুর কাজ শেষ করতে দিবারাত্রী পরিশ্রমকরছেন। পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হলে অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ আরেকটি মাইলফলক অতিক্রম করবে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলো একটি দেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক কিংবা মানবিকউন্নয়নের মতো অদৃশ্য উন্নয়ন না থাকলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি আঙ্গুলদিয়ে দেখাবার প্রয়োজন হয়না। উন্নত অবকাঠামোর জন্য ইউএই, কাতার, সৌদি আরব পশ্চিমাদের কাছে ঈর্ষার কারণ হচ্ছে।
বিশাল ভূসম্পত্তি, খনিজ সম্পদ এবং বিশ্বের সর্বাধিক মিঠাপানিরমালিক কানাডা। সম্পদ রক্ষায় কানাডার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টপর্যাপ্ত নয়। ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে থাকলেও অসংখ্য পণ্যবাহী ট্রাকযুক্তরাষ্ট্রের রুট ধরে মন্ট্রিয়ল থেকে ক্যালগেরি যায়। কিংবা প্রিন্সএডওয়ার্ড আইল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া যায়।
প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রদেশকে কানাডিয়ানরা সংক্ষেপে পিইআইবলে। মাত্র সিকি শতক আগেও পিইআই কানাডার মূল ভূমি থেকেবিচ্ছিন্ন ছিলো। সেন্ট লরেন্স উপসাগরে অবস্থিত দ্বীপটি নর্থাম্বারল্যান্ডপ্রণালী দিয়ে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। উড়োজাহাজ আর ফেরী চলাচলছিলো যোগাযোগের মাধ্যম। শীতকালে এ প্রণালী বরফে আচ্ছাদিতথাকে। বরফ কাটা বিশেষ ধরণের ফেরী ছাড়া অন্য ফেরী চলাচল সম্ভব নয়।
ইউরোপ থেকে তুলনামূলক নিকটবর্তী হওয়ায় এই দ্বীপে অভিবাসীমানুষের আগমন বেশ আগেই। ১৮৭৩ সালে এখানকার জনগণ সপ্তমপ্রদেশ হিসাবে কানাডায় যুক্ত হয়। এর দুবছর আগে ১৮৭১ সালে এঁরানিজস্ব রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। উন্নত সড়ক যোগাযোগপ্রতিষ্ঠা করে। সড়ক পথের দৈর্ঘ্য হিসেব করলে প্রিন্স এডওয়ার্ডআইল্যান্ড কানাডার সর্বোচ্চ ঘন সড়ক ব্যবস্থা। অর্থাৎ মোট ভূমিরআয়তনের তুলনায় রাস্তার পরিমান সবচে বেশী এই প্রদেশে।
অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সমৃদ্ধ এমন একটি প্রদেশ মূল দেশ থেকে আলাদাথেকেছে বহুকাল। অবশেষে ১৯৯৭ সালে নর্থাম্বারল্যান্ডার প্রণালীরউপর ব্রীজ নির্মিত হলে এটি সারাদেশের সাথে ভূতলে যুক্ত হয়।
ভৌগোলিক সংজ্ঞায় প্রণালী কোনো নদী নয়। নদীর উৎপত্তি ঝরণায়আর সমর্পণ হয় সাগরে। কিন্তু প্রণালী এক সাগর থেকে যায় অন্যসাগরে। কিংবা একই সাগরের এক অংশের সাথে অন্য অংশকে যুক্তকরে। পূর্ব পশ্চিম প্রবাহিত নর্থাম্বারল্যান্ড প্রণালী সেন্ট লরেন্সউপসাগরের এক অংশকে অন্য অংশে যুক্ত করেছে। প্রণালীর উত্তরেপ্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, দক্ষিণে নোভাস্কোশিয়া এবং নিউ ব্রান্সউইকপ্রদেশ। মোদ্দা কথায় নর্থাম্বারল্যান্ড প্রণালী একটি উপসাগরের অংশ।সেন্ট লরেন্স উপসাগরের অংশ।
আবার সেন্ট লরেন্স উপসাগর সরাসরি যুক্ত ল্যাব্রাডর সাগর এবংআটলান্টিক মহাসাগরে। দুই সাগর মহাসাগর জলের প্রতাপে ত্রস্তনর্থাম্বারল্যান্ড প্রণালী। মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো রয়েছে বরফেরউপস্থিতি। শীতকালে এই প্রণালীর পৃষ্ঠতলের কয়েক ফুট জল সম্পূর্ণশক্ত বরফ হয়ে যায়। সুতরাং সহজেই অনুমেয় এমন জলরাশিতে সেতুনির্মাণ কতোখানি চ্যালেঞ্জিং! কানাডিয়ানরা সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছে।
আইল্যান্ডকে মেইনল্যান্ডের সাথে যুক্ত করতে তোড়জোড় শুরু হয়েছিলো১৮৭০ সালেই, যখন রেল লাইন বসানোর পরিকল্পনা হয়। শুরুতে চিন্তাছিলো কোনো টানেলের মাধ্যমে কানাডার মূল ভূমির সাথে একে সংযুক্তকরা যায় কিনা। তাহলে ট্রেন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তবেপ্রযুক্তিগত সুবিধা এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় টানেলের পরিকল্পনাথেকে সরে আসতে হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের প্রস্তাব হয়। স্থাননির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। ব্রীজের প্রস্তাব কার্যকরীভাবে সামনেআসে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের ভেতর যেসব ফেডারেল নির্বাচনহয়েছে সেসময় কালে।
তবে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক চিন্তায় কয়েকবার ধাক্কা খায় ব্রীজপ্রকল্প। ফেরী এবং স্টীমার (স্টীমশিপ) শিল্পে সরকারী ও বেসরকারীবিনিয়োগ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ব্রীজ নির্মাণে। শেষ পর্যন্ত আশির দশকেরমাঝামাঝি ব্রীজের প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরেপরিবেশ এবং প্রতিবেশ সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষা শেষ হলে ১৯৯২সালের ডিসেম্বরে স্ট্রেইট ক্রসিং ডেভেলপমেন্ট ইনক নামের একটিপ্রতিষ্ঠানকে প্রকৌশল ডিজাইন, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং নির্মাণের সার্বিকদায়িত্ত্ব প্রদান করা হয়। যে স্থানে ব্রীজ নির্মাণ চূড়ান্ত করা হয়, সে স্থানেকেবল মূল ব্রীজের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ১২.৯ কিলোমিটার। অর্থাৎ ১০০ মিটারকম ১৩ কিলোমিটার।
ব্রীজ ডিজাইনের পালা এবার। পানির গতি প্রকৃতি, নদী গর্ভস্থ ভূমিরধারণ ক্ষমতা, প্রতিদিনের ট্রাফিক ভলিউম, হুইল লোড ইত্যাদি বিচারেকোন ধরণের ব্রীজ কম মূল্যে অধিক টেকসই করে বানানো যাবে তারদায়িত্ত্ব দেয়া হলো বিখ্যাত ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ার জাঁ মুলারকে। প্রকৌশলী জাঁমুলার ফরাসি, তবে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে পরামর্শক প্রকৌশলী হিসাবেকাজ করেন। সেখানেই থিতু হন। যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য ব্রীজ ডিজাইনকরেছেন তিনি। ব্রীজ ডিজাইন নিয়ে তাঁর ব্যাপক গবেষণা রয়েছে। তাঁরউদ্ভাবিত ম্যাচ-কাস্টিং পদ্ধতিতে এপোক্সি ব্যবহার করে প্রি-কাস্টকংক্রিটের ড্ৰাই জয়েন্ট অনেক শক্তিশালী ভাবে করা যায়।
বিশ্বের প্রায় সকল বৃহৎ সেতুই প্রি-কাস্ট কংক্রিট দিয়ে করা। প্রি-কাস্টকংক্রিট হলো যে “কংক্রিট স্ট্রাকচার” অন্য কোথাও থেকে ঢালাই করে আনা হয়। অর্থাৎ জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢালাই প্রয়োজন নাই। এ ক্ষেত্রেঢালাইকৃত বীম বা স্ল্যাব বা গার্ডার সম্পূর্ণ শুষ্ক অবস্থায় স্থাপনারযথাস্থানে রাখা হয়। অতঃপর দুটো বীম, স্ল্যাব বা গার্ডার প্রয়োজনমাফিক জোড়া লাগানো হয় নাট বল্টু দিয়ে। এই বোল্ট যখন কংক্রিটেপ্রবেশ করানো হয় তখন এপোক্সি ব্যবহার করা হয়। এতে জয়েন্ট অত্যন্তশক্তিশালী হয়। একত্রে পুরো অংশ ঢালাই করলে যেমন শক্তিশালী, ঠিক তেমনি শক্তিশালী জোড়া লাগানো কংক্রিট।
মেধাবী সেতু প্রকৌশলী জাঁ মুলার তাঁর বিশেষত্ত্ব অনুযায়ী মাল্টি স্প্যানব্যালেন্সড ক্যান্টিলিভার পদ্ধতিতে ব্রীজ ডিজাইন করেন, যা নির্মিত হবে পোস্ট টেনশনড প্রি-কাস্ট কংক্রিট বাক্স গার্ডার দিয়ে। অর্থাৎ প্রতিটিগার্ডার কংক্রিট বক্সের মতো হবে। একটির সাথে আরেকটি জোড়ালাগিয়ে লাগিয়ে ১৩ কিলোমিটার লম্বা ব্রীজ তৈরী হবে। ব্রীজে পিয়ার বাখাম্বা আছে ৬২ টি। এর ভেতর প্রধান ৪৪ টি পিয়ার ২৫০ মিটার পরপরঅবস্থিত। জলের উপরিভাগ থেকে ব্রীজের উচ্চতা ৪০ থেকে ৬০ মিটার।১৩ কিলোমিটার ব্রীজটির প্রশস্ততা ১১ মিটার।
১৯৯৩ সালের অক্টোবরে জাঁ মুলারের ডিজাইন অনুযায়ী কন্ট্রাক্টরনির্মাণ কাজ শুরু করে। স্ট্রেইট ক্রসিং ডেভেলপমেন্ট ইনকের কারিগরিসীমাবদ্ধতার কারণে নির্মাণ কাজে আরও দুটি কোম্পানির সাথে জয়েন্টভেনচার করে। এরা হলো নেদারল্যান্ডের ব্যালাস্ট নেদাম জিটিএমআইএবং কানাডার নর্দার্ন কনস্ট্রাকশন।
প্রি-কাস্ট কংক্রিটের তৈরী ব্রীজের বিভিন্ন উপাদান জয়েন্ট ভেনচারকন্ট্রাক্টর ভূমিতে রেখে তৈরি করে। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো ক্রেনদিয়ে সরিয়ে ব্রীজের সংশ্লিষ্ট স্থানে প্রতিস্থাপন করে। স্ট্রেইট বা প্রণালীরঅভ্যন্তরে বিশাল জাহাজ রেখে তার উপর ক্রেন প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রি-কাস্ট কংক্রিটের জন্য ডিউরেবল হাই গ্রেড কংক্রিট এবং রিইনফোর্সমেন্টরড ব্যবহার করা হয়। পিয়ার বেজ, আইস শিল্ড, মেইন স্প্যান, ড্রপ-ইনস্প্যান সবই তৈরি করা হয় প্রি-কাস্ট কংক্রিট দিয়ে।
৫ হাজার কর্মী যাঁদের ভেতর রয়েছেন সাধারণ শ্রমিক, বিশেষজ্ঞ কারিগর, সার্ভেয়র, নির্মাণ ব্যবস্থাপক এবং প্রকৌশলী, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ততদিনে খরচ হয়েযায় পুরো ১ বিলিয়ন ডলার।
ব্রীজের নাম দেয়া ছিলোনা। প্রকল্প চলাকালীন এ নিয়ে বিস্তর আলোচনাহয়। ফেডারেল সরকার ১৯৯৬ সালের মে মাসে প্রিন্স এডওয়ার্ডআইল্যান্ডের প্রিমিয়ার আলেক্স ক্যাম্বেলকে চেয়ারম্যান করে একটি নামনর্ধারণ কমিটি করে। ১০টি প্রদেশ আর ৩টি টেরিটরি নিয়ে কানাডা।সবার সাথে সবার ভূমি যোগাযোগ আছে। বাদ ছিলো কেবল প্রিন্সএডওয়ার্ড আইল্যান্ড। তাই কানাডা নামক বিশাল ফেডারেল সাম্রাজ্যথেকে একমাত্র বিচ্ছিন্ন দ্বীপকে যুক্ত করার ব্রীজের নাম দেয়া হয়কনফেডারেশন ব্রীজ। কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি।

ব্রামটন, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent