শুক্রবার - মার্চ ২৯ - ২০২৪

লংজিভিটি প্যারাডক্স

ছবিজে এনিংটন

ডেভিড সিনক্লিয়ারের বই পড়তে পড়তে এবং তার ভিডিওগুলো দেখতে দেখতে আরও কয়েকজন মানুষের খোঁজ পেলাম, যাদের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ নাওমি হোয়াইটেল, মার্কিন দেশের দুই নামকরা ডাক্তার যথাক্রমে স্টিভ গান্ড্রি এবং মার্ক হেইম্যান অন্যতম। তারা প্রত্যেকেই তাদের স্ব-স্ব ভূমিকায় অনন্য। ডেভিড নিসক্লিয়ার তো বটেই, এই তিনজনেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা এদের বয়সের তুলনায় দেখতে তরুণ। প্রত্যেককে তাদের বায়োলজিক্যাল বয়সের চেয়ে ২০ বছর কম দেখায়। যেমন ৫১ বছরের সিনক্লেয়ারকে লাগে ৩২ বছর বয়সী তরুণ, ৪৬ বছরের নাওমিকে দেখায় ২৭ বছরের তরুণী, আর ৭০ কি ৭৫ বয়সের ডাক্তারদ্বয়কে দেখায় ৬০-৬২।

যাহোক, কাছাকাছি সময়ে এই তিনজনের বইও সংগ্রহ করে ফেললাম। নাওমির বইয়ের শিরোনাম : গেøা১৫ , মার্ক হেইম্যানের ’ফুড : হোয়াট দ্যা হেক সুড আই ইট’  এবং গান্ড্রির ’লংজিভিটি প্যারাডক্স’ । তিন বইয়ের মূল কথা একটাই, আর তা হচ্ছে জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এবং তা করা গেলে রোগমুক্ত দীর্ঘ জীবনলাভ সম্ভব। প্রত্যেকে তাদের স্ব-স্ব লব্ধজ্ঞান নিজের উপরে প্রয়োগ করেছেন এবং তা থেকে লাভবান হয়েছেন। এছাড়া নানাসময়ে নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খবরাখবর দিয়ে বইগুলো ঠেসে দেওয়া হয়েছে, যেন পড়তে পড়তে চোখ আকাশে উঠে গেলে সেই অবিশ^াস ভরা চোখে কিছুটা ভরসা জন্মে। দিনশেষে বিশ^াসই মূল কথা, তা সেটা ভূতে হোক কি বিজ্ঞানে। যতবড় সত্যই হোক, বিশ^াস না করলে সেই সত্য অসহায়। সেজন্য পরিশিষ্টে সূত্রগুলোর তালিকা সাজাতে গিয়ে বইয়ের কলরব বড় হয়ে গেছে। মাসখানেকের মধ্যে তিনটি বই পড়ে শেষ করলেও আমার আগ্রহ জন্মায় লংজিভিটি প্যারাডক্সে। কারণ আমার কাছে এই বইটি ডেভিড সিনক্লিয়ারের বইয়ের পরিপূরক বলে মনে হয়েছে। সিনক্লিয়ার যেখানে কোষের গভীরের রহস্য উন্মোচনে ব্যস্ত, সেখানে ডাক্তার গান্ড্রির মনোযোগ খাদ্যনালি নিয়ে, সেখানে বসবাসরত ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। বহু বছর আগে গ্রিক দার্শনিক হিপোক্র্যাটের ’শরীরের সকল রোগের শুরু খাদ্যনালিতে’ নামের আপ্তবাক্যটিকে আরাধ্য মেনে তিনি তার গবেষণা চালিয়ে গেছেন এবং বইটি সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ।

- Advertisement -

এই লেখায় ডাক্তার গ্রান্ডি তো বটেই, মার্কিন দেশের স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যাস্টিন  সোনেনবার্গ ও তার স্ত্রী অধ্যাপক এরিকা সোনেনবার্গ এবং জার্মান দেশের ডাক্তার জুলিয়া  এন্ডার্সও নানাভাবে উদ্ধৃত হবে। এরা প্রত্যেকে গাট এবং ব্যাকটেরিয়া বিশেষজ্ঞ। কাজেই কেবল লেখা না, বন্ধুদের সাথে যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি, তখন ঘুরেফিরে ব্যাকটেরিয়া কিংবা কোষের চুলো বলে খ্যাত মাইট্রকন্ড্রিয়ার কথাগুলো আসে, তখন বইগুলো থেকে উদ্ধৃতি দিতে দেরি করি না।

জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখে শুরু, তারপর ৫ দিন করে পরপর দুই সপ্তাহ রোজা রাখার পরে শরীরের ওজন কমে গেলেও শরীর কোষ্ঠকাঠিন্য নামের এক আজব সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। এই সমস্যা আমার ছিল না। কেবল রোজা না, ভাত-রুটি থেকে শুরু করে নানা জাতের ফলমূল খাওয়া বন্ধ করায় খাদ্যনালিতে বসবাসরত ব্যাকটেরিয়াদের বড় একটা অংশ হয়তো অনাহারেই পটল তোলে। আর এই দুর্ভিক্ষের মাঝেও যারা বেঁচে যায়, তারা হয়তো খাদ্যনালীতে আসা অল্পস্বল্প খাবার নিয়ে মারামারি শুরু করে দেয় এবং তাদের সেই মারামারির ক্ষেত্র হয়তো পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত থেকে বৃহদান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ফলে, নরমহাগু রসনিংরানো ছোবড়ার মতো কঠিন হয়ে যায়। ডাক্তার গ্রান্ডি কিংবা জাস্টিন সোনেসবার্গের লেখা বইগুলো আগে পড়া থাকলে এ সমস্যা এড়ানো যেতো। যাহোক, লেসন লার্নড বলে একটা কথা আছে, যার বাংলা হচ্ছে ঠকে শেখা। আমাদের শেখার বড় অংশই তো ঠকে বা ঠেকে শেখা। কোরআনের সূরা ফাতিহায় সুপথপ্রাপ্ত পূর্বপুরুষদের অনুসরণের কথা বলা হলেও কতজনই বা তা করে? এই প্রজন্মে এসে ইন্টারনেট কিংবা গুগুলে প্রাপ্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঠেলায় আমরা বরং অতীতকে অস্বীকার করেই গর্ববোধ করি। ডাক্তার গ্রান্ডিও ব্যতিক্রম ছিলেন না। অন্যান্য আমেরিকানদের মতো মুটিয়ে যাওয়া এই সার্জন সাহেব দুই অপারেশনের মাঝের বিরতিতে কোকাকোলা পান করতেন, বার্গার খেতেন। এখন লাজশরমের মাথা খেয়ে সেই দুর্দান্ত মূর্খতাগুলোকে স্বীকার করে নিচ্ছেন।

 

কী মূর্খতা ছিল না সেখানে?

বার্গার তো ছিলই, সাথে টমেটো কেচাপ দিয়ে মেখে মেখে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বড় গøাসে কোক না হলে পেপসি, মাঝেমাঝে পিৎজা বা পাসতা, গরু বা শুয়োরের মাংসের স্টেক, সাথে ম্যাশ পটেটো, সালাদ থাকতো বটে কারণ সকলের এক কথা যা খাচ্ছো খাও, সালাদটা যেন থাকে; কাজেই টমেটো, শশা কিংবা লেটুস পাতা দিয়ে বানানো সালাদ এবং নিঃসন্দেহে তাতে যুক্ত থাকতো অলিভ অয়েল কিংবা আপেল সিডার ভিনেগার। সকালের নাস্তা শুরু হতো বেগেল, দুধ-সিরিয়াল কিংবা ওটমিল দিয়ে। তারপর সন্ধ্যার আগে আরও কয়েকবার খাওয়া হয়ে যেতো― ডোনাট, ম্যাপেল পিকান ড্যানিস, হানি ক্রোলার, ক্রিম রোল থেকে শুরু করে কী না থাকতো, আর ডবল ক্রিম ডবল চিনিতে ঠাসা কফি না হলে দিনের শুরুটা হয় বা কীভাবে, আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসেই বা কীভাবে। ৭টায় ডিনার হয়ে গেলে আরামসে সোফায় বসে টিভি ছেড়ে দিয়ে বিয়ার বা হুইস্কি পান, তারপর অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে রাত গভীর হয়ে নামলে মনে হয় যে, কিছু একটা না খেলে ঘুমই তো আসবে না। ফ্রিজ খুলে অরেঞ্জ জুস না হোক আপেল জুস কিংবা ক্যানবেরি। আর হরেক রকমের ফলফলাদি তো আছেই, সেখান থেকে কলা না হোক আঙুর খেতে তো অসুবিধা নেই। সেগুলো খেতে খেতে শরীর মোটা হয়ে গেলে জিমে গিয়ে ২-৩ ঘণ্টা ব্যায়াম কিংবা বাইরে দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, কোনোকিছুই বাদ যেতো না। তা সত্তে¡ও শরীর মোটা হয়ে যায়, নানা ধরনের অসুখ বাসা বাঁধে এখানে ওখানে। ডাক্তারের শরীরে অসুখ! কী শরমের কথা!

এখন তিনি বলছেন উল্টো কথা। গমজাত, তা রুটিই হোক কি পরাটা কি নানরুটি, বিস্কিট, পাসতা― সকলকিছু হারাম। সব ধরনের ডাল, বাদামের পরিচয়ে পরিচিত ডাল যেমন: ক্যাশনাট, পিনাট (চীনাবাদাম)― এসবও হারাম। এমনকি বেগুন কিংবা টমেটোও হারাম। তবে ডালকে উচ্চচাপে সেদ্ধ করে খেলে বা ফলজাতীয় সবজি অর্থাৎ বেগুন বা টমেটোর বিচি ফেলে দিয়ে খেলে ভিন্ন কথা। পটল, লাউ কিংবা মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার বেলায় আমরা বরাবরই বিচি ফেলে দিই, অথবা খেলেও বিচির আবরণটা অন্তত ফেলে দিই, সেটা সীম হোক কি মিষ্টি কুমড়া। কিন্তু বেগুন, জুকিনি কিংবা টমেটোর বেলায় না বুঝেই খেয়ে ফেলি। ডাক্তার গ্রান্ডির মতে, এসবে থাকে লেকটিন নামের এক বদমায়েশ প্রোটিন। মূলত উদ্ভিদ তার নিজের বংশ বিস্তারের প্রয়োজনে ফলের জন্ম দেয় এবং নিজেকে রক্ষার জন্য সেই ফলের গর্ভে খুবই শক্তিশালী এই প্রোটিন জমিয়ে রাখে, যা খেলে প্রাণীকুল অসুস্থ হতে বাধ্য। কৃষি সভ্যতার আগে মানুষ এসব খাবার খেতো না, খাওয়ার প্রয়োজনও হতো না। মানুষের শরীর এখন পর্যন্ত এই লেকটিন হজমের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। গমকে যেভাবেই পরিশোধিত করা হোক না কেন তাকে লেকটিনমুক্ত করা সম্ভব না। অনেকটা লোম্বা বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার মতো অবস্থা।কিন্তু ফলের বেলায় মানুষ এই লেকটিন নামক অপশক্তিকে অপসারণ করে বা তাকে নির্মূল করেই খায়, অর্থাৎ, তারা বিচি ফেলে দেয়। অনেকে না জেনে সবজি বিবেচনায় বিচিসহ ফল (বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, জালি, জুকিনি, বেগুন ইত্যাদি) খায়, অথবা এত বাছবিচার করে না; ফলে গম বা লেকটিনযুক্ত ফল খেয়ে বিপদ ডেকে আনে শরীরের মধ্যে। এই লেকটিন তখন পেটের পর্দা, যাকে ইংরেজিতে ইন্টেসটিয়াল লাইনিং (রহঃবংঃরহধষ ষরহরহম)  বলে, তাকে ছিদ্র করে দেয়, আর সেই সেই ছিদ্র বেয়ে বেহুলার সোনার সংসারে ঢুকে পড়ে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, এমনকি খাবারের কণিকা। পেটের পর্দার ছিদ্র, ইংরেজিতে যাকে লিকিগাট বলে, তাকে বন্ধ না করা পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়ার এই অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায় না, যুদ্ধও থামে না। ডাক্তার স্টিভ গ্রান্ডি এর জন্য লেকটিন নামক প্রোটিনকে দায়ী করলেও স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপক এবং দ্যা গুড গাট বইয়ের লেখক জাস্টিন ও এরিকা সোনেনবার্গের অভিমত কিন্তু আলাদা। এই অধ্যাপকদের মতে, বৃহদান্তে বসবাসরত ব্যাকটেরিয়ার খাবারে সংকট দেখা দিলে তখন পেটের পর্দায় থাকা মিউকাসকে তারা খেতে শুরু করে, আর এভাবে মিউকাস পাতলা হতে হতে একসময় তাতে ছোট ছোট ফুটোর জন্ম হয়। সেটাই লিকি গাট। আমার পক্ষপাত অবশ্য এই অধ্যাপকদ্বয়ের প্রস্তাবিত মতবাদের প্রতি। কারণ ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত সমীক্ষার আওতায় বৃহদান্তে অবস্থানরত ব্যাকটেরিয়াদের খাবার হিসেবে আঁশযুক্ত খাবারের তারতম্যের ফলশ্রæতিতে মিউকাস পর্দার পুরুত্বে যে উঠানামা করে তার একটা ফটোগ্রাফও তারা তাদের বইয়ে সেঁটে দিয়েছেন, যা দেখে যে কেউ এই মতবাদের দিকে হেলে পড়তে বাধ্য।

তা যেভাবেই লিকিগাট হোক, পেটের পর্দায় ছিদ্র মানে সেটা দিয়ে ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য অণুজীবগুলো আমাদের শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। আর একবার শরীরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হলে অশান্তি শুরু হতে বাধ্য। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখন তাকে খতম করতে ঢাল তলোয়ার নিয়ে নেমে পড়ে, শুরু হয় যুদ্ধ। আমাদের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডাক্তাররা এসব ছিদ্র-ফিদ্র নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাদের হাতের কাছে আছে এক অব্যর্থ অস্ত্র, যার নাম অ্যান্টিবায়োটিক, সেটা প্রয়োগ করে পেটের মধ্যেই ব্যাকটেরিয়াকে খতম করে দেয়। ফলে ছিদ্র থাকলেও সেই পথে কেউ আর সংসারে ঢুকে পড়ে না। আমরা ভাবি, যাক বাঁচা গেল। আসলে সেই বাঁচাটা চলে মাত্র কয়েকদিন। ততদিনে সেই ছিদ্র যদি বন্ধ হয়ে না থাকে, তো সেই ছিদ্রপথে আবারো ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটে। এভাবে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে, আর শরীরজুড়ে চলতে থাকে ব্যথা―; হাড়ে ব্যথা, গিড়ায় ব্যথা, মাথায় ব্যথা, মাংসের পেশিতে ব্যথা, এই ব্যথা বাড়তে বাড়তে একসময় বাতের ব্যথা কিংবা আর্থারাইটিসে রূপ নেয়। তখন নানারকমের ব্যথানাশক অসুধ খেয়ে নিজেদের সান্ত¡না দেই। আবার ব্যাকটেরিয়া মারতে গিয়ে ভালোমন্দ দুটোকেই মেরে ফেলার কারণে শরীর বেকুব বনে যায়। তখন ভালো ব্যাকটেরিয়ার অভাবে হজমে গন্ডগোল দেখা দেয়, নানারকমের ভিটামিন ও এনজাইমের অভাব দেখা দেয়, খাবারে অরুচি দেখা দেয়, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, শরীর দুর্বল থেকে দুর্বল হতে থাকে।

ডাক্তার গ্রান্ড্রি, ডাক্তার জুলিয়া কিংবা অধ্যাপক সোসেনবার্গের মনোযোগ তাই এই গাট ব্যাকটেরিয়ায়। কয়েক হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিকের মতো অসুখের উৎস খুঁজতে এই একবিংশ শতাব্দির রমরমা বিজ্ঞানভিত্তিক সময়েও স্টিভ গ্রান্ডি তার ২৫ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সার্জারি পেশাকে দু-পায়ে ঠেলে ওই পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং সেখানে ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করেন। কোষের শক্তিকেন্দ্র মাইটকন্ড্রিয়ার সাথে পেটজুড়ে বসবাস করা ব্যাকটেরিয়াদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবিত হন। আর জার্মানির জুলিয়া তো তার ডাক্তারি বিদ্যা শুরুই করেন এই গাট ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করে। অধ্যাপকযুগলের কথা না-ই বা বললাম। আসলে এরা দু’জন পথ না দেখালে বাকি বিশ^ হয়তো ব্যাকটেরিয়ার কারবার নিয়ে এতদিন কিছু জানতোই না।

গ্রান্ডির প্লান্ট প্যারাডক্স প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার। কাজেই, বইটিকে সংক্ষেপে বর্ণনা করা সহজ কথা না। তবে, চেষ্টা করলে গুরুত্বপূর্ণ যে অংশগুলো চোখে পড়বে, তা হচ্ছে কী খেলে পেটের পর্দায় ছিদ্র হয়, কী কী খেলে সেই ছিদ্র বন্ধ করা যায় এবং কী কী খেলে পেটের ভেতরে ব্যাকটেরিয়ার বাগানে শতফুল প্রস্ফুটিত হয়। যত ফুল তত সৌন্দর্য, আর সেই সৌন্দর্য তখন উপচে পড়ে আমাদের চেহারায়, আমাদের ত্বকে। উজ্জ্বল ত্বকের জন্য তখন আর বাইরের আস্তরণে রঙের প্রলেপ দিতে হয় না। সংখ্যায় আমাদের শরীরের মোটের কোষের চেয়ে পেটের ভিতরের ব্যাকটেরিয়া ২ কি ৩ গুণ বেশি। ভালো হোক কি মন্দ, তারা আমাদের খাবার খেয়ে খেয়ে নানা জাতের এনজাইম নিঃসরণ করে, আর রক্তের গাড়িতে চড়ে সেই এনজাইমগুলো আমাদের শরীরের কোষে পৌঁছে যায়। শুধু তাই নয়, ব্যাকটেরিয়াগুলো মগজের কাছে সংকেত পাঠায় এবং শরীরের কোষের মধ্যে বসবাসরত মাইটকন্ড্রিয়ার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে। পড়তে পড়তে আনমনা হয়ে যাই। কারণ লেখক বলছেন যে, লক্ষ বছর আগে অ্যামিবার মতো নানা এককোষী প্রাণীর হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষার এক মহাপ্রকল্পের আওতায় ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রাণীদেহকে আবিষ্কার করে এবং সেই দেহের কোষের মধ্যে মাইটকন্ড্রিয়া নামক সহোদরকে বসিয়ে দিয়ে প্রাণীদেহকে তাদের উপনিবেশ বানায়। কালক্রমে আদি প্রাণীদেহ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের পর্যায়ে এলেও মাইটকন্ড্রিয়ার নির্ভরতা থেকে বিশে^র কোনো প্রাণীই মুক্ত হতে পারেনি। মাইটকন্ড্রিয়া নিয়ে অধ্যাপক ডেভিড সিনক্লিয়ারের মন্তব্যটি মনে পড়ে যায়। তার মতে, জীবনের শুরুতে শরীরের কোষের সাথে মাইটকন্ড্রিয়ার সম্পর্ক সখা-সখির মতো, তারা সারাক্ষণ একে অন্যের খোঁজ-খবর করে; কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই সম্পর্কের মাঝে ভাটা নামে, আর তখনই অসুখ-বিসুখ এসে চেপে ধরে শরীরকে। ব্যাপারটি কি এরকম যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের পেটের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, আর সেই কারণে কোষের মাইটকন্ড্রিয়া হতাশ হয়ে অপরিচিতের আচরণ করে। আর কারো না হোক, ডাক্তার গ্রান্ডির ধারণা কিন্তু সেটাই। সেজন্য লিকিগাট ঠিক করা থেকে শুরু করে পেটে নানাজাতের ব্যাকটেরিয়ার অভয়ারণ্য গড়ার পক্ষে তার যুক্তি দিয়ে বইটি ভরা।

পেটের ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি পুরো বইটি পড়ে যে খাবারটির প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব নজরে পড়বে, সেটা এক্সট্রা-ভার্জিন অলিভ অয়েল বা খাঁটি জলপাই তেল। এটা জানা কথা যে, দীর্ঘায়ুর পথের পথিকগণ বিশ^ব্যাপী এই তেলের ভক্ত। এটাও জানা যে, সেই রহস্যের পেছনে কাজ করছে পলিফেনাল  নামক এক উপাদান। কেবল জলপাই না, মরিচ আদা রসুন দারুচিনি থেকে শুরু করে নানা শাকসবজি এবং জাম, আমলকি, স্টবেরির মতো রঙিন চামড়ার শত শত খাবারের চামড়ায় পলিফেনাল আছে। মূলত, পোকার আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গাছগাছালি এই উপাদান ব্যবহার করে। কিন্তু জলপাই তেলে পলিফেনাল ছাড়াও আরও অনেক বিরল উপাদান আছে, যার জন্য সকলের মতো ডাক্তার গ্রান্ডির প্রথম পছন্দ এই তেল। নিয়মিতভাবে জলপাই তেল খেলে ডায়াবেটিস, আলঝাইমার, ডিমনাশিয়ার মতো অসুখ তো হয়ই না, বাড়তি হিসেবে অটোফ্যাজির মতো কোষের নবজন্ম লাভের সেই দুর্লভ কর্মটির সূচনা করতেও সে দারুণভাবে কাজ করে।

গাট ব্যাকটেরিয়া নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্যই জুন মাসের শেষে অধ্যাপক জাস্টিন ও অধ্যাপক এরিকা সোনেনবার্গের লেখা “দ্যা গুড গাট: টেকিং কন্ট্রোল অব ইয়োর ওয়েট, ইয়োর মুড, অ্যান্ড ইয়োর লং-টার্ম হেল্থ।” কিংবা ডাক্তার জুলিয়া এন্ডার্সের লেখা “গাট: দ্যা ইনসাইড স্টোরি অব আওয়ার মোস্ট আন্ডাররেটেড অর্গান।” বই দুটো সংগ্রহ করে আনি। বিষয়বস্তুর দিক থেকে খুব কাছাকাছি হলেও অধ্যাপকদের মনোযোগ এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণ আবিষ্কার করা, আর ডাক্তার জুলিয়ার মনোযোগ ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাংগাসজনিত নানা রোগ বালাইকে চিহ্নিত করা। এসব পড়তে পড়তে এসিড রিফ্ল্যাক্স থেকে শুরু করে কনস্টিপেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অসুখের নিরাময় নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারি। এ বইয়ের শেষের দিকে এগুলো সংযুক্ত করা হল। আগ্রহীরা উপকৃত হবে বলে আশা করি।

ক্যালগেরি, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent