শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

অনন্য আতিথেয়তায় স্যাম

নব্বইয়ে বেইজিং এশিয়ান গেমস চলাকালীন পরিচয় হয়েছিলো এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়নের (আসপু) সাধারণ সম্পাদক মালয়েশিয়ান সাংবাদিক জর্জ দাসের সাথে। একই সময় তিনি নিজ দেশের স্পোর্টস রাইটার্স এসোসিয়েশন অব মালয়েশিয়ার (স্যাম) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। বাংলাদেশকে আসপুর সদস্য পদ পেতে এ ভদ্রলোকের অবদান অনেক বেশী। বেইজিং গেমসেই আগাম দাওয়াত দিয়ে রাখলো পরের বছর (১৯৯১) কুয়ালালামপুর এশিয়ান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড চ্যাম্পিয়নশীপ কভার করার জন্য। মাথায় তখন বাংলাদেশকে আসপুর সদস্যপদ এনে দেবার চিন্তা। আর জর্জ দাস আসপুরই সাধারণ সম্পাদক। অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর আমি তখন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির (বর্তমানে নাম পরিবর্তন করে যা এখন ‘বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস এসোসিয়েশন) জয়েন্ট সেক্রেটারী (ইন্টারন্যাশনাল)। সাংবাদিকতায় আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব মূলত: আমার ওপর। মনে মনে ভাবছিলাম, কুয়ালালামপুর যেতে পারলে মন্দ হয় না। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। চ্যাম্পিয়নশীপও কভার করা হবে পাশাপাশি আসপুর সদস্যপদ পেতে লবিংয়ের কাজটাও এগিয়ে নেয়া যাবে। আসলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কোনো অর্জনই লবিং আর চেনা-জানা ছাড়া হয় না। বেইজিং এশিয়াড কভার করতে গিয়ে এ অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছিলাম।
কিন্তু কিভাবে যাবো? আমার কর্মস্থল দৈনিক বাংলার বাণী এ্যাথলেটিক্স কভার করার জন্য আমাকে নিশ্চয়ই পাঠাবে না। আজকের দিনের মতো সে সময় ক্রীড়া সাংবাদিকদের তেমন সুযোগ ছিলো না যত্রতত্র গেমস, টুর্ণামেন্ট কভার করার। সে সময় এক সন্ধ্যায় বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের অফিসে বসে আড্ডা মারছি। উদ্দেশ্য ‘এক্সক্লুসিভ’ কোনো সংবাদ বের করা যায় কিনা। আড্ডায় অলিম্পিক এসোসিয়েশনের মহাসচিব মরহুম জাফর ইমাম ও অন্যান্য দু’চারজন কর্মকর্তা। জাফর ভাই বেশ পশ জীবন যাপন করতেন। খেলা পাগল মানুষ। স্ত্রী রাজশাহীতে নামকরা গাইনোক্লোজিষ্ট। কথায় কথায় বললাম, মালয়েশিয়া ট্যুরের কথা। খুব উৎসাহ দেখালেন। বললেন, এশিয়ান সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য পদ পেতে তোমার এ ট্যুর জরুরী। জাফর ভাই বহুবার বিদেশ চষে বেড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে লবিংয়ের ভাষা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েও খোলামেলা কিছু জ্ঞান দিলেন। লবিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতাও মেলে ধরলেন। সবশেষে বললেন, তোমাদের এই শুভ উদ্যোগে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমি তোমার এয়ার টিকিট স্পন্সর করবো। এর কিছুদিন আগেই মালয়েশিয়ান স্পোর্টস রাইটার্সের পক্ষ থেকে আমাকে লিখিত এক আমন্ত্রণ পত্রে চ্যাম্পিয়নশীপ চলাকালীন আমার সমস্ত লোকাল হসপিটালিটি তারা বহন করবে বলে জানায়। অর্থাৎ হোটেল, খাওয়া-দাওয়া ও সে সাথে প্রতিদিন হাত খরচ বাবদ ৯০ মালয়েশিয়ান রিংগিট দেয়া হবে।
ব্যস, আমার কর্মস্থল দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক সেলিম ভাইকে (শেখ ফজলুল করিম সেলিম) জানালাম। ‘অন ডিউটি’ ছুটি মিললো দশ দিনের। সাথে একাউন্টস সেকশন থেকে অল্প কিছু ডলার নিয়ে যাবার কথাও বলে দিলেন। দেরি না করে বাংলাদেশ এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনকে জানিয়ে দিলাম, চ্যাম্পিয়নশীপ কভার করার বিষয়টি।
পাঁচজন এ্যাথলেটসহ বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়নশীপের দু’দিন আগে রওয়ানা হয়ে গেলো কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে। আমি রওয়ানা হলাম পরদিন বাংলাদেশ বিমানযোগে। ব্যাংককে তিন ঘণ্টার ট্রানজিট। সেখানে ট্রানজিট লাউঞ্জে দেখা হলো পাকিস্তান ডন পত্রিকার প্রবীন সাংবাদিক মি: বোখারী, করাচি টাইমসের সারাহ এলাহী, নেপালের বীর বাহাদুর থাপা, শ্রীলংকা অবজারভারের উইরাউয়ানসা, ভারতীয় স্টেটসম্যান পত্রিকার শ্যাম সুন্দর ঘোষ সহ অনেকের সাথেই। ব্যাংককে ট্রানজিট শেষে আমরা সবাই একসাথে থাই এয়ারলাইন্সে রওয়ানা হলাম মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে নামতেই ঘটে গেলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা! আমার আগে দাঁড়ানো সাংবাদিকরা পাসপোর্টে সীল নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হচ্ছেন। আমার সিরিয়াল আসতেই আটকে গেলাম ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে। আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কী যেনো আলাপ করছে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের ওপারেই আমাদের স্বাগত: জানাতে তখন মালয়েশিয়ান স্পোর্টস রাইটার্সের সাধারণ সম্পাদক জর্জ দাস সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। ওপার থেকেই বারবার জিজ্ঞেস করছেন তোমার কী সমস্যা? যতোবারই জিজ্ঞেস করছে ততোবারই আমার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। সবুজ পাসপোর্টের যে কি দশা, তখন তা পলে পলে উপলব্ধি করছি। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা হয়তো ভাবছেন আমার ‘গলাকাটা পাসপোর্ট’ কিনা! এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেই বসলো, তোমার পাসপোর্ট কি জেনুইন? বুঝলাম, সন্দেহের মাত্রাটা বাড়তেই থাকবে। অগত্যা ইমিগ্রেশনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা জর্জ দাসদের দিকে আঙ্গুলি হেলনে জানিয়ে দিলাম আমি তাঁদের অতিথি। প্রায় ত্রিশ মিনিটের এ নাটক শেষ হলো ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ওপর জর্জ দাসের সরাসরি হস্তক্ষেপে। বলতে দ্বিধা নেই, সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে এর আগে ও পরে অনেক দেশ সফরে বেরিয়েছি, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা ছিলো এই প্রথম!
যাইহোক, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়ান সাংবাদিক মিস হেরুনীর ব্যক্তিগত গাড়ীতে চেপে রওয়ানা হলাম হোটেলে। গাড়ীর মধ্যেই তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়। আর পরিচয়ের সূত্র ধরেই জানলাম সে মুসলিম। ২৬ বছর বয়স। কাজ করছে মালয়েশিয়ান জাতীয় দৈনিক ‘দি ট্রিবিউন’-এ। হোটেলে পৌাঁছতেই আমার হাতে এক দিনের পকেট মানি ৯০ রিংগিট ধরিয়ে দিয়ে বললো, কাল দেখা হবে এ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে। সেখানেই দিয়ে দেয়া হবে বাকী দিনগুলোর পকেট মানি। হেরুনী হোটেল রুমের জানালা দিয়ে চিনিয়ে দিলো এ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়ামের পথ। মাত্র সাড়ে সাত মিনিটের হাঁটা পথে আব্দুল আজিজ এ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়াম। হেরুনীর আতিথেয়তা প্রথম দিনেই আমার মন জয় করে নিলো।
পরদিন দুপুরে এশিয়ান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড চ্যাম্পিয়নশীপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। দু’ঘন্টা ব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো বটে, তবে মন ভরলো না। এক ফাঁকে হেরুনী এসে খবর নিয়ে গেলো আমার সব কিছু ঠিকঠাক আছে কী না। বললাম, কুয়ালালামপুর শহরটা একটু ঘুরে দেখতে চাই খেলার ফাঁকে ফাঁকে। বললো, এটা নিয়ে ভেবো না, তুমি সহ চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা সাংবাদিকদের দেখভাল করার দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। আমাদের সাংবাদিক এসোসিয়েশনের সদস্যদের এমন ভাবেই ভাগ করে দেয়া হয়েছে বিদেশী মেহমানদের আতিথেয়তায়। মনটা ভরে গেলো হেরুনীর কথা শুনে। কী চমৎকার আতিথেয়তা!
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় হেঁটে সোজা হোটেলে ফিরলাম। তখনও কুয়ালালামপুর শহরের উন্নতি আর সৌন্দর্য দেখা হয়ে ওঠেনি। শুধু হোটেল থেকে স্টেডিয়াম যাওয়া আর আসার রাস্তাটা চিনেছি মাত্র। মালয়েশিয়ানদের হৃদয়ের নায়ক, অবিসংবাদিত নেতা মাহাথীর মোহম্মদের সৃষ্টি আর সভ্যতার নিদর্শনগুলো দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম হেরুনীকে না বলে একাই বেরিয়ে যাবো কুয়ালালাপুর শহরটা ঘুরে ফিরে দেখতে।
পরদিন পাঁচ এ্যাথলেট বিটিএমসির মেহেদী হাসান ও মিলজার হোসেন এবং সেনাবাহিনীর গিয়াসউদ্দিন, আফজাল হোসেন ও ফরিদ খানসহ ৭ সদস্যের দল মাঠে থাকবে কোচ আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে। প্রথম দিনেই চরম হতাশাজনক ফলাফল। পাঁচ এ্যাথলেটের প্রত্যেকেই তাঁদের হিটে সর্বশেষ স্থান নিয়ে ফাইনাল রাউন্ড থেকে বাদ। আর সে সাথে শেষ বাংলাদেশ দলের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাও। মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে বাংলাদেশ দলের লজ্জাজনক এ ফলাফলের নিউজ বাংলার বাণীতে পাঠিয়ে আর মন চাইলো না শহরটা ঘুরে দেখার। হেরুনীর সাথে রাতে কুয়ালালামপুর দেখার ইচ্ছেটাও মাটি হয়ে গেলো।
পাঁচদিন ব্যাপী এই এশিয়ান ট্র্যাকে চীন সর্বোচ্চ ২৪টি স্বর্ণ নিয়ে মেডেল তালিকায় শীর্ষস্থান লাভ করে। জাপান ও কাতার ৪টি করে স্বর্ণ জিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নিশ্চিত করে। আর দক্ষিন এশিয়দের মাঝে ভারত ২টি স্বর্ণ, ৪টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জ নিয়ে ঠাঁই পায় পঞ্চম স্থানে। পাকিস্তান ২টি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ এবং শ্রীলংকা একটি ব্রোঞ্জ জয় করে এই মিট থেকে। আর বাংলাদেশ? পদক জয় তো দুরে থাক, বাছাই পর্বের বাধায় অতিক্রম করতে পারেনি!
চ্যাম্পিয়নশীপের শেষ দিন। সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ করে বিশাল আয়োজন সংবর্ধনার। এশিয়ান ৩৮টি দেশ থেকে এই মিট কভার করার জন্য আসা বিদেশী সাংবাদিকদের সম্মানে স্পোর্টস রাইটার্স এসোসিয়েশন অব মালয়েশিয়ার (স্যাম) বিশাল নৈশভোজ। প্রতিটি দেশের সাংবাদিকরাই এই চ্যাম্পিয়নশীপ কভার করতে এসেছেন নিজ নিজ দেশের উদ্যোগে। একমাত্র আমিই এসেছি স্যাম এর অতিথি হয়ে। বিষয়টি আগে জানা না থাকলেও এই নৈশভোজে স্যাম সম্পাদক জর্জ দাসের স্বাগত: বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রথম জানতে পারলাম। এমন ঘোষণায় বিদেশী সব সাংবাদিকের চোখ তখন আমার দিকে। বিষয়টি জেনে আমি যেমন অসম্ভব পুলকিত, তেমনি নার্ভাস। স্টেজে নিশ্চয়ই ডাকবে কিছু বলার জন্য। কি বলবো, কি বলে এই সম্মানের প্রতিত্তর জানাবো। এমনটি ভাবতে ভাবতেই স্যাম কর্মকর্তারা আমাকেই প্রথম ডেকে বসলেন। নার্ভাসনেস নিয়েই ডায়াসে উঠলাম। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় কি বলেছিলাম হুবহু তা আজ আর মনে নেই। তবে মনে আছে, জর্জ দাসের ভাষায়: অল্প কথায় চমৎকার।
এই সফরে মালয়েশিয়ানদের আতিথেয়তা ভুলবার নয়। সাংবাদিক ও সাধারণ মালয়েশিয়ানদের সাথেও মিশে দেখেছি ওরা কতোটা অতিথি পরায়ন। চীন, ভারত বংশোদ্ভুতদের সাথে মালয়রা মিলে মালয়েশিয়ান। আর এই তিন জাতিকে এক করে মাহাথীর মোহম্মদ মালয়েশিয়াকে নিয়ে গেছেন দেশ গড়ার প্রেমে, অতিথি পরায়নতার সর্বোচ্চ শিখরে। জয়তু মাহাথীর।

- Advertisement -

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent