শুক্রবার - এপ্রিল ২৬ - ২০২৪

প্রিয় শহর

ছবিলিওনার্দ কোটে

কখনো কেউ যদি জানতে চান, ঢাকা-নারায়নগঞ্জের পর  আপনার প্রিয় শহর কোনটি?

একবাক্যে বলবো, ‘প্যারিস, প্যারিস এবং প্যারিস।

- Advertisement -

এরপর?

বার্লিন এবং কোলকাতা।

কেন?

এর কারন একটি হতে পারে। এই তিনটি শহর শিল্প, সাহিত্য,সংস্কৃতির জন্য আমাকে হৃদয় থেকে টানে। এই তিনটি শহরে আমি ১৪ বার করে গিয়েছি শুধুই ভালবাসার টানে। শহর দুটোতে পা দেয়া মাত্রই  কেন যেন মনে হয় আপন শহরেই এসেছি!

আপন মনেই বলে উঠি,

জয়তু প্যারিস

জয়তু বার্লিন

জয়তু কোলকাতা

সেই ভালোবাসার শহর প্যারিস নিয়ে রীতিমতন একটি বই লিখেছি। তাই এবার লিখছি জার্মানের নানান সময়ের ভ্রমন অভিজ্ঞতা।বারবার ঘুরে ফিরে আসবে প্রিয় শহর বার্লিনের কথা। হয়তো কোন এক সময় লিখব আরেক প্রিয় শহর কোলকাতা নিয়ে।

এক সাপ্তাহ হলো বার্লিন এসেছি। টুকটাক কাজ ছিল সেগুলো সারা হয়ে গেছে।আরো দু’চারদিন পর যাব প্যারিস। সেখান হতে ঢাকায় ফিরবো।

সকাল থেকেই  বার্লিনের আকাশ মেঘাচ্ছন। ঠান্ডা  হিমেল হাওয়ায় হাঁড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নাতিশীতোষ্ণ  অঞ্চল থেকে আসা এই আমার পক্ষে ভারী শীতবস্ত্রেও   ঠান্ডাকে বাগে আনা কঠিন।

শুধুই কি ঠান্ডা?

দুপুর থেকে একটানা টিপ টিপ টিপ বৃস্টি  ঝরছে তো ঝরছেই।

ঠিক এসময় রাসেলের ফোন।

– রনি ভাই, এড্রেস বলেন। এক্ষুনি আপনার কাছে আসবো।

রাসেলকে এড্রেস বলি। আমরুমার স্ট্রাসে। উ -বানের  পাশে হাউজ নাম্বার এলফ (এলাভেন) ।

– আমি আসছি।

রাসেল সময় নিল মাত্র আধঘন্টা।

এড্রেস অনুযায়ী চলেও এলো। রাসেল আসার পরে এলো আমার কাজিন বাবু।

ওরা দুজনেই বার্লিন এসেছে পড়াশুনোর উদ্দেশ্যে । একজন এসেছেন পিএইচডি করার জন্য। অন্যজন গ্রাজুয়েশন করার জন্য। দুজনেই মেধাবী ছাত্র। পড়ছে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাসেল আর আমি একসাথে  সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের রাজনীতির সাথে যুক্ত  ছিলাম। এখনো আমরা বাসদ এর রাজনীতির সাথে  যুক্ত । অনেকদিন পর দেখা রাসেলের সাথে। দেশের চলমান সংকট, মিডিয়ার অবস্থা, প্রবাস জীবন, দেশ নিয়ে উদ্বেগ , আশা-নিরাশা,স্বপ্ন নিয়ে কত কথা!  আমাদের গল্প কথা যেন ফুরাতেই চায় না!

ওদের দু’জনের সাথে কথা বলে একটা বিষয় খুব পরিস্কার বুঝতে পারি, ওরা দেশ কি পরিমান অনুভব করে, ভালবাসে। প্রবাসে যারা থাকেন তাদের  আষ্টেপৃষ্টে ও অন্তরে সবসময় বাংলাদেশ থাকে ।

দুপুরে গরম ভাত, ডিম ভাজা,ইলিশ মাছ, মুরগীর মাংসের ভুনা আর ডাল দিয়ে আহার সেরেই সন্ধ্যা পর্যন্ত দুর্দান্ত এক লম্বা আড্ডা হলো।

কফি খেতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু বাসায় যে চিনি ফুরিয়েছে, জসিমভাইয়ের তা মনে নেই।

বাবুকে বললাম, চলো, আগে কফি খেয়ে শরীর গরম করি। তারপর এদিক সেদিক যাওয়া যাবে।

বিকেলের আলো ফুরিয়ে যাবার আগেই রাসেল ও বাবুকে নিয়ে বের হই গরম কফি খাওয়ার উদ্দেশ্যে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা আমরুমার স্ট্রাসের ওপর একটি কফিশপের ভেতর বসি। অনেক বুড়ো-বুড়ি বসা।বিশাল মগ তাদের সামনে। জার্মানীদের বিয়ার প্রীতি যেমন রয়েছে, তেমনি বড় মগে চুমুক দিয়ে কফি খাওয়ার প্রীতি অজানা নয়। এর আগেও আমি অনেকবার দেখেছি বুড়ো-বুড়িদের বড় বড় মগে কফি খেতে।

সেখানে হঠাৎ দেখা হলো আমার পরিচিত একজনের সাথে। তার কাছে শুনি, আমার অস্থায়ী নিবাসের পাশে এক জার্মান ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন।

কি বলেন?

আঁতকে উঠি। এখানেও খুন খারাবি?

হান্নানভাই জানালেন, মহিলা তার পরিচিত ছিলেন, একসাথে দীর্ঘদিন একটি ইলেকট্রনিকস ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানীতে কাজ করেছেন। কাজ ছেড়ে আসার পরও ভদ্রমহিলার সাথে মাঝেমাঝে ফোনে কথা হত। সকালে মহিলার খুন হবার খবর শুনে তার ভীষন মন খারাপ হয়ে আছে।

হান্নানভাইয়ের কথা শুনে আমাদেরও মন বিষাদগ্রস্থ হয় অপরিচিত এই জার্মান নারীর জন্য।

জানি না মহিলা কি যৌন হয়রানি বা শ্লীতাহানি ঠেকাতে গিয়ে খুন হয়েছে কিনা! জার্মানে যে কোনো ধরণের যৌন হয়রানি, স্ত্রী নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়৷ এমন কি ধর্ষণের সময় আক্রমণকারীকে বাঁধা দেয়ার ঘটনা প্রমাণ  না করা গেলে অথবা প্রতিরোধের কোনো ঘটনা না ঘটলে তাকে ‘ধর্ষণ’ বলে গণ্য করা হয়৷ অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে ধর্ষণ বা অচেতন অবস্থায় কেউ ধর্ষিত হলে, তাঁর যে শ্লীলতাহানি হয়েছে তা মেনে নেয় আদালত৷ সেই দেশে একজন নারী খুন হয়েছে শুনে একটু অবাকই হই।

কফি শেষ করে হান্নানভাইয়ের সাথে ঘটনাস্থল দেখতে যাই। আমরুমার স্ট্রাসে আমার অস্থায়ী বাসস্থানের পাশের গলিতে খুন হওয়া মহিলার এপার্টমেন্ট। দুই মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই।

হান্নানভাই কার কাছে যেন ফোন করে জানতে পারেন, ভদ্রমহিলা পারিবারিক কলহে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। বিল্ডিংয়ের সামনে বেশ ক’জন মানুষ ফুল মোমবাতি নিয়ে এসেছেন শ্রদ্ধা জানাতে। দরোজার পাশে ফুল, মোম্বাতি থরে থরে সাঁজানো। সবার মন ভারাক্রান্ত। মুখাবয়বে বিষাদের ছায়া।

তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করে জানলাম , যারা  ফুল নিয়ে এসেছেন, তারা সবাই টিভি দেখে ও অনলাইনে নিউজ পড়ে এসেছেন শ্রদ্ধা জানাতে।

ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষগুলো কোনোদিন খুন হওয়া মানুষটিকে দেখেনি। তার সম্পর্কে কিছু জানেও না ! অথচ মানুষের প্রতি তাদের কি অসীম মমতা,  ভালবাসা!

জার্মানীদের এই মানবিকতা, ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। পরক্ষনে নিজেদের কথা ভেবে মন খারাপ হলো। আমাদেরতো অন্যের জন্য সময়ই নেই , টেলিফোন কিংবা মেসেঞ্জারে কুশলাদি বিনিময় করাও অহেতুক সময়ক্ষেপণ ভাবি।

বিকেলের আলো ফুরিয়ে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে চারিদিকে নিয়ন আলোর ঝলকানিতে। বিষাদগ্রস্থ মন নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। হান্নানভাই,রাসেল ও বাবুকে বিদায় করে বাসায় ফিরে আসি। অচেনা জার্মান নারীটির জন্য আমার মন যতোটা ভারাক্রান্ত তারচেয়ে বেশী মন খারাপ লাগছে ভদ্রমহিলার দু’টো নিস্পাপ জমজ বাচ্চার জন্য। মায়ের স্নেহ ভালবাসা কি তিন বছরের দু’টো বাচ্চা কখনোই বুঝবেই না।

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent