বৃহস্পতিবার - এপ্রিল ১৮ - ২০২৪

অসাধারণ জয় যাত্রার বৃত্তান্ত

জেসি থীসল ও লেখক ননীগোপাল দেবনাথ

বিশ্বের দেশে দেশে জনপদে মাদকাসক্তির প্রভাব বহুকালের, তবে বাংলাদেশে বর্তমানে যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতবাহী। যেহেতু আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ঔপনিবেশিক আচরণবিধির রেস বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আলাদা, তাই মাদকাসক্তি ও গৃহহীনতার স্বরূপ এবং কারনও আলাদা। সংশোধন ও এর আগ্রাসন থেকে উত্তরণের বিধিব্যবস্থার পরিচালনাও ভিন্ন হতেপারে, তবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ফলপ্রসূ সমাধানের উদ্যোগ নিশ্চয়ই নিরর্থক হবেনা।

ক্রেক কোকেনের অন্ধকারাচ্ছন্ন বলয় ও গৃহহীন জীবনকে জয় করে আজ অসাধারণ এক মানুষ, জেসি থীসল্। নিম্নে বর্নিত তার সাফল্যময় কাহিনী থেকে আমরা প্রেরণা পেতেপারি এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আজ অতি প্রাসঙ্গিক মনেকরি।

- Advertisement -

কানাডার আদিবাসী মেটিস্ বংশোদ্ভূত বিদ্যানুরাগী জেসি থীসল্ (এম. এ’ ১৬) এখন পি.এইচ. ডি করছেন টরন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। যার মাথা গোঁজার যায়গা ছিল না, একসময় কানাগলি বা পায়ে চলার পথ ছিল তার আস্তানা, ছিলেন সমাজ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন এক গৃহহীন। জীবন ক্রেক কোকেন নেশাগ্রস্ত এবং ছোটখাট চুরি বা অতি সাধারণ অপরাধের জন্যে জেলে যাওয়া আসা ছিল অহরহ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। জেলে সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ অবস্থায় অপ্রত্যাশিতভাবেই তার হৃদয়ে একদিন চেতনা জেগেছিল যে, এভাবে চলতে থাকলে সে মরেই যাবে । জেলখানায়ই কর্তৃপক্ষের প্রণোদনায় পড়াশুনা শুরু করেছিলেন, তার  একটি সুচিন্তিত ভাবনা জীবনের চাকাকে বিপরিত দিকে সমৃদ্ধির পথে প্রশংসনীয়ভাবে চালিত করেছিল। মাদকাসক্তি সহ দুর্বিসহ জীবন কে জয় করে আজ তিনি এক অকল্প মানুষ, বলা যায় তাঁর পুনর্জন্ম প্রাপ্তি হয়েছে ।

কানাডার সাস্কাচুয়েন প্রদেশের ক্রী ঐতিয্যের বাসিন্দা, চরম দুর্গতি, দরিদ্রতা ও অচল অবস্থার মাঝে ফিরে দাঁড়িয়ে, তিনি আজ জ্ঞানের সাধনায় ব্রতী । নিজের জীবনই শুধু নয়, আলোকিত করতে চান তার মত স্বদেশী এবং সকল কানাডীয়দের যারা আজও গৃহহীন ।

জেসি থীসলের জীবন ভিত্তিক সিমন এন্ড স্কাষ্টার প্রকাশিত বই, ‘মাই লাইফ’, একটি মেটিস্ স্মৃতিচারণ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মানের কাজও আসন্ন প্রায়।

পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, শারীরিক, মানসিক দুঃসহ ক্ষতের উপশমের বিস্তৃতি লাভ শুধু নয়, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের দ্বারা, জ্ঞানার্জনের উচ্চশিখরে উঠে কানাডার গৃহহীনতার সমাধানে এক প্রতিকরূপে কৌশলী ভূমিকা রাখছেন তিনি । মৃদুভাষী থীসলের ভাষা আজ প্রতিধ্বনিত অতি উচ্চস্বরে ও পরিচ্ছন্নভাবে, সারা কানাডাবাসী যাহা শুনছেন ।

গত ২০১৭সালে তিনি মেনিটোভা প্রদেশের উনিপেগে একটি জাতীয় সম্মেলনে বিদগ্ধ সমাবেশে উপস্থাপন করেন, “কানাডায় স্বদেশী গৃহহীনতার সংজ্ঞা,” একটি পান্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা মূলক, অতি মূল্যবান রচনা যাতে রয়েছে কানাডায় উঠন্ত এই সামাজিক সমস্যার দ্রুত সমাধানের নির্দেশনা ও প্রস্তাবনা।

টরন্টোর সেন্ট ম্যাইক্যাল হাসপাতালের প্রথম মেটিস্ পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী ডাক্তার ড. জেনেট সামিয়েলী, ডাক্তার ও গবেষকদের প্রতি থীসলের সংজ্ঞার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যিনি থীসলকেও আমন্ত্রন জানিয়েছেন পেকিউয়েউনের (হোম কামিং) প্রধান অন্বেষী হতে এবং গবেষণা চালাতে । পেকিউয়েউন একটি স্বদেশী স্বাস্থ্য ও সমাজশৃঙ্খলাকারী সংস্থা, আদিবাসী সন্তানদের জন্য তথ্য সম্বলিত ও প্রতিপালনের সেবায় নিয়োজিত। এই পদক্ষেপ সম্প্রতিক থীসলের সংজ্ঞার মাঝে যে জ্ঞানগর্ব অভিজ্ঞতা নিহত রয়েছে তাহা ভাষান্তরিত করবে, ডাক্তারদের অনুভবযোগ্য সুনির্দিষ্ট ধারণা ব্যক্ত করবে এবং দেশ ব্যাপী সমাজকর্মী যারা গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করেন তাদের সেবা দানে সহায়ক হবে।

কানাডার গৃহহীন মানমন্দির, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিরপেক্ষ গবেষণা ও কার্যপ্রণালী গঠনে ব্রতী সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী শহর এলাকায় প্রতি ১৫ জন আদিবাসীর মাঝে একজন গৃহহীন, তুলনামুলক বাকী জনগোষ্টির মাঝে ১২৮ জনে একজন।

অধিকন্তু, বড় শহর এলাকায় আদিবাসীদের গৃহহীনতা সর্বমোট গৃহহীনদের তুলনায় ২০ হতে ৫০ ভাগ, এমনকি কোন কোন শহরে প্রায় ৯৬ ভাগ । এই চরম পরিস্থিতির যথার্থ মোকাবেলা না করতে পারলে সম্ভবত আরো অবনতি অনিবার্য।

“কানাডীয় গৃহহীনতার সংজ্ঞা, একটি এলাকার জনগোষ্ঠীর বাসস্থানকেই শুধু বিবেচনায় রেখেছে, কিন্তু আদতে এটি মাথা গোঁজার যায়গার প্রশ্ন শুধু নয় আরো অনেক জটিল, পরিবার ও সামাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন সমস্যাকন্টকিত,” থীসলের এমনই অনুভূতি।

“গৃহহীনতা আদিবাসী পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিক ভাবে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত বহন করে, তাদের জমি, ঐতিহ্য, পরিচিতি, কৃষ্টি, কাহিনী, প্রথা এবং ভাষা, বলা যায় সামাজিক বন্ধনের সবকিছু,” বিদ্যানুরাগী নিজ অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘদিনের বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগে গবেষণার আলোকে মন্তব্যের সমর্থনে এমনটাই ব্যক্ত করেন।

“এই বিচ্ছিন্নতা সমাজের একই সূত্রে গাঁথা পরিধি থেকে ছিনিয়ে নেয়া জীবন বলে বিশ্বাস, আদিবাসী সমাজ বিষয়ে জ্ঞানের দৈন্যতা রয়েছে ব্যাপক ভাবে, এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে।” তাই তিনি প্রস্তুত করছেন বিভিন্ন কর্মপন্থা ও প্রণালী, গৃহহীনতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুনর্বিবেচনা ও প্রয়োগ করে যেন সরকার অগ্রসর হতে পারে।

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের অধ্যাপক এবং গৃহহীনতা ও গৃহহীনদের কেন্দ্রস্থল কানাডীয় মানমন্দিরের পরিচালক স্টিফেন গেইটর্য বলেন থীসলের সংজ্ঞা এবং কার্যক্রম অভূতপূর্ব। সম্প্রতি স্টিফেনকে ‘রেইজিং দ্যা রূফ’ নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও নিয়োগ করা হয়, দীর্ঘমেয়াদী গৃহহীনতার সমাধানের প্রতি মনোনিবেশ করা যার উদ্দেশ্য।

উন্নতমানের বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রক্রিয়ার অবলম্বনে থীসল যে সংজ্ঞার উদ্ভাবন করেছেন তাহা সত্যিকারভাবে অর্থপূর্ণ ও শক্তিশালী । তার উপলব্দিতে শুধু আদিবাসী গৃহহীনতা নয়, সার্বিক গৃহহীনতার সমাধানের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে এতে। তিনি বলতে চেয়েছেন গৃহহীনের বাসস্থান এবং একটি গৃহের মাঝে পার্থক্য বুঝতে হবে, আমাদের ঐতিহাসিক ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের সূত্র অনুস্মরণে আনতে হবে। তার উদ্দীপক কার্যক্রম আমাদের আশান্বিত করে, আমরা একজন মহান ইতিহাসবেত্তা পেতে যাচ্ছি। কানাডার সকল আদিবাসী সম্প্রদায়ও তার প্রবর্তনকে সমর্থন এবং সাহায্য করছে।

থীসলের বিগত দিনের যন্ত্রণাগ্রস্ত জীবন গভীর ভাবে সম্পৃক্ত কানাডীয় ইতিহাসের একটি শোচনীয় অধ্যায়ের সাথে, যাহা আজ পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখবে তার মহান সংজ্ঞা।

অলঙ্কৃত এই বিদ্যানুরাগীর সুবিন্যস্ত টেবিলে কালিতে আঁকা এক মহান সৈনিকের চিত্র শোভাপায় সবসময়, এই মহাত্মাই ছিলেন কানাডার সুবিস্তীর্ণ তৃণাবৃত আলবার্টা অঞ্চলের শক্তিশালী আদিবাসীদের প্রধান নেতা মিস্টওয়াসিস্ এবং বৃটিশ ক্রাউনের সাথে ১৮৭৬ সালে চুক্তি ছয়ের স্বাক্ষরকারী, (যে দলিলের ফলশ্রুতিই আজকের গঠিত সাস্কাচুয়েন ও আলবার্টা) তারই গর্বিত বংশধর হলেন থীসল।

উক্ত চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিস্টওয়াসিস্ আশা করেছিলেন তার জনগণের অপরিহার্য ও দীর্ঘমেয়াদী জীবনধারণের সুব্যবস্থা হবে। শান্তির সেই প্রয়াস হয়েছে সত্যিকারে স্বল্পকালস্থায়ী। তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মই চরম হতাশায় ভুগতে থাকে এবং দূর থেকে পরিচালিত সরকারের প্রতি অবিশ্বাসের জন্মনেয়। এমনকি সেই পরিস্থিতিতে তাদের পূর্বপুরুষ ও প্রধান নেতার নাতনী ১৮৮৫ সালে লুইস্ রিয়ালের সাথে উত্তর-পশ্চিম কানাডার বিপ্লবীদের সাথে যোগদেয়। এই বিপ্লবে বৃটিশ নিয়ন্ত্রিত বাহিনীর কাছে বটোসির যুদ্ধে মেটিস্ বাহিনী হেরে যায় এবং লুইস্ রিয়ালকে রাজদ্রোহী বলে ফাঁসি দেয়াহয়, সেই সময় থীসলের পরিবার সমাজ বিচ্যুতহয়ে নির্বাসিত হয়েছিল।

“আমরা ‘রাস্তায় থাকা ভাতাভুগিদের (রোড় এলাউন্স পিপোল) দলের লোক হয়েছিলাম,’ রেললাইনের দুপাশে যে সীমিত পতিত জমি থাকে সেখানে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম।” থীসল স্পষ্ট ভাষায় বলতে চেয়েছেন, “ আমরা সমাজ বিস্মৃত লোকে পরিণত হয়েছিলাম ” ।

সেই প্রারম্ভিক স্থানচ্যুতি এবং হারানো সামাজিক কাঠামো, তার পরিবারের কয়েক প্রজন্মের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে প্রায় শতবর্ষ যাবৎ, যার পরিণামে আজো তাদের বিবিধ ভোগান্তি যেমন মাদকাসক্তি, জেলখাটা ও গৃহহীনতা।

থীসলের পিতাও নেশাগ্রস্থ ছিলেন অবশেষে তাকে হত্যা করাহয় এবং তার মার পরিণতি ছিল আরো অবাস্তব প্রকৃতির, তিন পুত্রকে (থীসল ও তার দুইভাই) তিনি পরিত্যাগ করে  পিতামহের কাছে টরন্টোতে ছেড়ে চলেযান। জীবনের কোন শ্রীবৃদ্ধির মুখ তাই দেখতে পাননি শিশুকাল থেকে।

 “আমার মনে আছে ১৫ বছর বয়সে সেই দৈন্যের দিনগুলোর ভার বহন করেছি কিন্তু বুঝার ক্ষমতা ছিলনা কী ঘটছে,”  ক্রমাগত বলে যান থীসল, “আমি ক্ষুব্ধ ও প্রায় বিদ্বেষপূর্ণ হয়েপড়ি। সেই উত্তেজনার সময় ক্রেক কোকেইন নিতে আরম্ভকরি। আমি সংযোগ খুঁজেপাই অনেকের সাথে যাদের পটভূমি এবং জীবন কাহিনী প্রায় আমারই মত।”

উচ্চপর্যায়ে মাদক ও মদ্যে ঘোরগ্রস্ত, থীসল স্কুল থেকে অন্তর্হিত এবং তার মোক্ষম স্থান ছিল তখন কানাগলি বা পায়েচলা রাস্তা, যে বদ অভ্যাসে রপ্ত হয়েছিলেন তার যোগান দিতে ছোটখাট চুরি ছিল অবলম্বন। অনেকবার ধরাপড়ে কারারূদ্ধ হয়েছেন, আদালত তাকে কয়েক দফায় বারবার সংশোধনের সুযোগ দিলেও প্রতিবার সে অগ্রাহ্য করে। বছরের পর বছর বিষাদপূর্ণ জীবন চলছিল এভাবেই।

 কিন্তু একদা ২০০৫ সালে জেলেবসে ভাবছিলেন, তার একটি পা গ্যাঙ্ গ্রীন্ গ্রস্ত, প্রায় হারাতে বসেছেন সেই পা খানি। থীসলের মনে শুভবুদ্ধির উদয়হল, ঈশ্বরের কাছে তিনি প্রার্থনা ও প্রতিজ্ঞা করলেন এদফায় সেরে উঠলে ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তার সেই প্রার্থনায় উপযোগী সাড়া পেয়েছিলেন। অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কারানিবাসে শিষ্টাচারের উপর পাঠ্যধারার একটি পাঠ তিনি গ্রহন করেছিলেন, এগিয়ে চলার মনোবল কিছুটা ফিরে পেয়েছিলেন, একটি পরিপাটি জীবন যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।

 তারপর আরো কয়েকটি পাঠ্যক্রমে উচ্চমান সম্মত ফল পেয়েছিলেন, ঐসব প্রশংসাপত্র এখন  ঘরের বৈঠকখানার দেয়ালে যথাযোগ্য মর্য্যাদায় তার সশ্রদ্ধ নিবেদন, “একদিন বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির পাশে নিজের নামটি দেখে আবেগপ্রবণ ও অনুপ্রাণিত হয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন,” থীসল এটি সবার সাথে সহভাগ করতে চান, “আমি আগামীদিনে নিজের নতুন লক্ষ্য স্থীর করেছিলাম।”

বয়স যখন ৩৩ “আমি একজন অতি সংযমী ধীর-স্থির প্রকৃতির লোক,” আবার স্কুলের ক্লাশে ফিরে গিয়ে হাই স্কুলের ফলাফল অসাধারণ হয়েছিল, তাদেখে একজন শিক্ষক উচ্চশিক্ষায় অনুসরণকারী হতে উৎসাহিত করেছিলেন। থীসল তাই করেছিলেন এবং ২০১৫ সালে ইয়র্ক থেকে ইতিহাসে বি,এ এবং ২০১৬ তে ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এ ডিগ্রী লাভ করেন । তাছাড়া উল্লখযোগ্য গভর্নর জেনারেলের ভূষিত কয়েকটি পুরষ্কার এবং পিয়ারে ইলিয়ট ট্রুডো সংস্থাপনার ৬০ হাজার ডলারের ছাত্রবৃত্তি সমেত, শিক্ষায়তনিক ১৩ টি মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কারও অর্জন করেন এযাবতৎ।

২০১৬ সালে থীসল পুনঃ ইয়র্কে আসেন এবার পি.এইচ. ডি করতে এবং আশা পোষন করছেন ২০২২ সালের মধ্যে কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন হবে ।

পড়ালেখা ও গবেষণার ব্যাপক ব্যস্ততার মাঝে তার নিজ ভাগনীকে, সেই বংশোদ্ভূত দুর্গতি থেকে মুক্ত জীবনে ফিরিয়ে আনার সর্বতো প্রচেষ্টার ত্রুটি করছেন না। তার গবেষণায় এজাতিয় বাস্তব ঘটনাবলী সৌভাগ্যবহ বস্তুুর ন্যায় দৃষ্টাকর্ষক হবে এবং পরিচ্ছন্ন উদাহরণ রাখবে।

 “আমি মাউথওয়াস পান এবং কোকেন সেবন করেছিলাম,” তিনি আবারো ব্যক্ত করলেন, “জানিনা আমার মস্তিষ্কের জীবকোষ গুলো কিভাবে বেঁচে আছে ?” নিজেই জানালেন, আদতে তার স্মরণ শক্তি এখনো খুবই ভাল, বলাযায় প্রায় কেমেরায় ছবিতোলার ন্যায়, যাহাকিছু তিনি পড়েন তার প্রতিচ্ছবি স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেন অনায়াসে।

এতটা দুঃসহ জীবন অতিক্রম করেও থীসল মনের সুস্থতা ও ভারসাম্যতা বজায় রেখেছেন, তার জীবন নব আশার সঞ্চার করবে কানাডীয় এমনকি বিশ্ব সমাজে, আজও যারা দুর্দশার প্রান্তে সংগ্রামে রত, তাদের প্রাণিত করতে ।

আরো অনন্য দিক, থীসলের মা তার সাফল্যমন্ডিত জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেতে চেয়েছেন, যিনি ছেলের কাছথেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর । তিনিও পুনঃ স্কুলে পড়তে গেছেন ছেলের অব্যাহতি পাওয়ার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, থীসল যাহা প্রবর্তিত করতে চাইছেন তার বংশধর ভাইবোনদের দুর্দশাপূর্ণ অধ্যায় থেকে সুস্থ পরিবেশে ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশায় ।

“আমার প্রবর্তনার গভীর শেঁকড়ে রয়েছে পারিবারিক ভালবাসা ও মমতা,” থীসল বলেন, “আমি কখনোই আমার কর্মকান্ড ও অভিজ্ঞতা একান্ত ব্যক্তিগত রাখিনি।”

যে জীবন ছিল এত দুর্বিসহ, অকিঞ্চিত্কর ও মানসিক আঘাত প্রাপ্ত, সবকিছু অতিক্রম করে থীসল যেভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তিনি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমাজের পদদলিত সকলকে উচ্চতর পর্যায়ে তুলে আনার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন। তার সেই মহৎ আকাঙ্খা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার আগ্রহ জন্মে এই অনুচ্ছদের লেখক হিসাবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ননীগোপাল দেবনাথের, তাই যোগাযোগ তারিখ ও সময় নির্ধারন করে একদিন পৌঁছে গেলাম ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী ছাত্রকেন্দ্রে ঠিক দুপুর ১২ ঘটিকায়, যেখানে থীসল ছিলেন আমার অপেক্ষায়। আলোচনা শুরু হওয়ার পর দুই ঘন্টা অনায়াসে এবং অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণভাবে দুজনার পরিতৃপ্তি নিয়ে কিভাবে শেষ হয়েছে, আমাদের কথপোকথন পড়লে পাঠকবৃন্দ জানবেন ও সুখী হবেন আশাকরি। 

সূত্র : ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ ফলসেশনের ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ।

জেসি থীসল ও ননীগোপাল দেবনাথের  সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের পর ।

ননী   : জেসি তোমার আসল বা পুরো নাম কি ?

জেসি : আমার পুরো নাম জেসি আডরিয়ান থীসল ।

ননী   : জেসি তুমি মাদকাসক্তি, দৈন্যতা ও মর্মপীড়াসহ প্রায় হারিয়ে যাওয়া জীবন কে জয় করে আজ এক অসাধারণ মানুষ হয়েছ, তোমাকে আমার অভিবাদন, শুধু তাই নয় তুমি সমাজে এখনো যারা গৃহহীন ও সংগ্রামেরত তাদের উৎকর্ষ সাধনে হাতবাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছ তার জন্য তোমাকে আমার স্যালিউট ।

জেসি  : তোমাকেও ধন্যবাদ, আমার যাত্রা শুরু হল মাত্র আরো অনেক অর্জন করতে হবে সকলে মিলে, আশাকরি আমি একানই । 

ননী   : তুমি বি,এ এবং এম,এ পাঠ্যক্রমে ইতিহাসের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো নিয়ে পড়েছ, আর এখন পি.এইচ.ডিতে বিষয়টি কি ?

জেসি  : বি,এ তে ছিল কানাডায় আদিবাসীর ইতিহাস, এম,এ তে মেটিস্ জাতির ইতিহাস এবং বর্তমানে পি.এইচ.ডি করছি “রোড এলাউন্স পিপোল্ ইন কানাডা” ।

ননী   : “রোড এলাউন্স পিপোল্ ইন কানাডা” বিষয়টি কি বুঝিয়ে বলবে ?

জেসি : আসলে আদিবাসীগণ যখন তাদের নিজবাড়ী, জমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, বৃটিশ ক্রাউনের হস্তক্ষেপে, তাদের অনেকের বাসস্থান হয় বড় রাস্তা বা রেললাইনের ধারে পতিত জমিতে, তবে বেঁচে থাকার জন্যে সরকার কিছু আর্থিক করুণা দেখাত, তার নাম ছিল ‘রোড এলাউন্স’ ।

ননী  : কানাডায় ১৮৪৭-১৯৯৬ সালের মধ্যে বেশ কিছু আবাসিক মডেল স্কুল ছিল আদিবাসী সন্তানদের জন্য, যার ইতিহাস পীড়াদায়ক । সেই স্কুল পরে সরকার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল, এই স্কুলের সাথে তোমার কোন সরাসরি নিজ অভিজ্ঞতা রয়েছে কি ?

জেসি : না আমার নিজের নেই, তবে আমার পরম পিতামহ অন্টারিওতে আবাসিক মডেল স্কুলের ছাত্র ছিলেন, অনেক করুণ কাহিনী আমি পরিবারের সদস্যদের কাছথেকে জেনে ব্যথিত হয়েছি ।

ননী  : এসব আবাসিক মডেল স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অতি কঠোর ব্যবহার করাহত বলে জানা যায়, এমনকি সন্তানদের জোরপূর্বক মাতা-পিতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অনেক দূরের স্কুলে রাখাহত যেন মাতা-পিতা ইচ্ছা করলেই ছেলেমেয়েদের সাথে মিলিত হতে না পারে । তোমার দৃষ্টিকোনে বৃটিশ ক্রাউনের এত কঠোর ব্যবস্থার প্ররোচনা কী ছিল বলে মনেহয় ?

জেসি : প্রধান কারণ ছিল আদিবাসী পরিবারকে বিভাজন করে দুর্বল করা যাতে তাদের জমি সম্পত্তি আত্মসাৎ করা সহজ হয় । দ্বিতীয়ত কানাডার বিস্তির্ণ তৃনাঞ্চলে কৃষি উৎপাদনের যথাযোগ্য উর্বর ভূমিতে আধুনিক কৃষিকাজের জন্য উপযোগী শ্রমিক শ্রেণী তৈরীকরা । তাছাড়া উন্নত সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়ার নামে আদিবাসী সন্তানদের নিজ ভাষা, ঐতিয্য এবং পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা ।

ননী  : তুমি বংশ পরম্পরায় এবং অকিঞ্চিত্কর সামাজিক মানসিক সংঘাতের পরেও নিজেকে জ্ঞানগর্বে প্রতিষ্ঠিত করেছ, তোমার মত শতকরা কতজন তোমাদের সমাজে এভাবে সাফল্য লাভ করেছে ?

জেসি : আমার বয়সের খুবই কম, শতকরা তিন চারজনের বেশী নয়, তবে আজকাল কিশোর বা যুবকরা যারা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে সেখানে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ সফল হচ্ছে ।

ননী  : বিশ্বব্যপী লক্ষ্য করলে দেখা যায় বিভিন্ন দেশে উপজাতি বা গোষ্ঠী তোমাদের মতই নির্যাতিত হয়েছে বা হচ্ছে তাদের উত্তরণের জন্য তোমার কি প্রস্তাবনা ও পরামর্শ ?

জেসি : অনেক কটি দিকে জনগন ও সরকারকে দৃষ্টিদিতে হবে ।

১) সত্য ইতিহাস জানার ব্যবস্থা নিতে হবে ।

২) বঞ্চিতদের শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি দিতে হবে ।

৩) সমাধানের লক্ষ্যে সেমিনার, আলোচনা সভা বাড়াতে হবে ।

৪)  যেসব ক্ষেত্রে চাকুরি হলে তারা পুনঃ বঞ্চিতদেরকেই বেশী সহায়তা করতে পারে সেখানে নিয়োগ বেশী দিতে হবে ।

৫) সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুযোগ দিতে হবে ।

ননী  : তোমার জীবন কাহিনী নিয়ে একটি চলচ্চিত্র হতে চলেছে, সেখানে তুমি নিজে অভিনয় করবে কিনা ?

জেসি : হাঁ চলচ্চিত্র হচ্ছে, তবে আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করবনা ।

ননী  : সাধারণত মা-বাবার সাফল্যে সন্তানরা অনুপ্রাণিত হয়, কিন্তু তুমি তার ব্যতিক্রম, তোমার মা জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন, তোমার অসাধারণ অর্জনের পর তোমাকে দেখে তোমার মাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং তোমার মত এখন স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেছেন । এই ক্ষেত্রে তোমার অনুভব কি ?

জেসি : এখন আমি ও আমার মা অত্যন্ত সুখী, আমার সমাজ ও পরিবারের সদস্যগণ একে সুস্পষ্টভাবে একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত রূপে দেখছে, তাই আমি আনন্দিত ও গর্বিত । প্রায়সই আমি মাকে দেখতে যাই, একসাথে সুন্দর সময় কাটাই, আমি মায়ের মমতা ফিরে পেয়েছি, আমি আজ ধন্য ।

ননী  :  আবাসিক মডেল স্কুলে যে শিক্ষা দেয়া হত তার রূপরেখা এমন ছিল, বলাহত আদিবাসী সংস্কৃতি নিম্নমানের, তাই উচুমানের পাঠ্যক্রমের প্রসারে সুশিক্ষার প্রবর্তণ করা হচ্ছে, আদতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের কৌশলে কেথলিক খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তিকরণ করা হত ! আদিবাসীদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আলাদা অবশ্যই ছিল, তবে ধর্মীয় বিশ্বাস কি ছিল বা আছে ?

জেসি : আদিকাল থেকে আজ অবদি আমাদের বিশ্বাস প্রকৃতিই ধর্ম, এই আলো, বাতাস, ঝড়, বৃষ্টি, পরিবেশ সবকিছু প্রকৃতি নয়ন্ত্রন করছে । দেখ আমরা পরিবেশকে যত্ন না করলে ফলাফল দৃশ্যমান ।

ননী  : কানাডাতে আজ বর্ধিত গনতন্ত্র রয়েছে, মানবাধিকার নিয়ে আমাদের সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে কথা বলে, তবে তোমাদের অধিকার প্রশ্নে তারা এখন কতটা পক্ষপাতহীন বা সম্ভাবনাময় ?

জেসি : তোমরা জান ২০১২ সালেও আদিবাসীরা আন্দোলনে নেমেছে, অন্টারিওতে আইপারওয়াস প্রভিনসিয়াল পার্কের কাছে ১৯৯৫ সালেও অধিকারের কথা বলতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে  ডুডলে জর্জ । প্রতিশ্রুতি থাকলেও ন্যায্য প্রাপ্তি কখনো হয়নি ।এখনো সরকার আলোচনা করছে বা চেষ্টা করছে কিন্তু সময়তো কারো অপেক্ষায় থাকেনা ।

ননী  : সরকারতো তোমাদের জন্য ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করেছে ২০০৫ সালে, তার অগ্রগতি কতটা ?

জেসি : হাঁ কমিশন হয়েছে, ভাল প্রস্তাবনাও হয়েছে, তবে আজ অবদি ৬৬ প্রস্তাবনার মাঝে মাত্র ছয়টি বাস্তবায়ণ হয়েছে । ভাল কাজের গতি অতি মন্থর ।

ননী   : তোমাকে আমি অনেক প্রশ্ন করলাম, তোমার কি আমাকে কোন প্রশ্ন রয়েছে ?

জেসি : হাঁ অবশ্যই, দেখতে পাচ্ছি তুমি আদিবাসী সম্পর্কে ইতঃপূর্বেই অনেক কিছুজান, তোমার এই জানার প্ররণা কোথায় ?

ননী   : একদিন পত্রিকায় আদিবাসীদের আন্দোলনের উপর একটি সংবাদ পড়ি ২০১২ সালে, আমাদের বাংলাদেশেও আদিবাসী রয়েছে তাদের সংগ্রামের কথা আমরা জানি, কানাডা পূর্ণবর্ধিত গণতান্ত্রিক দেশ তাই চমকে উঠলাম, এখানেও আদিবাসীদের অধিকারের জন্য আজও লড়তে হচ্ছে ? একটু বিস্তারিত জানার আগ্রহ জন্মে, বেশকিছু ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে তোমাদের আবাসিক মডেল স্কুলের করুণ কাহিনী জানতে পারি । এই মডেল স্কুলের ইতিহাস নিয়ে একটি নিবন্ধও লিখেছি, তাহা প্রকাশিত হয়েছিল একটি ম্যাগাজিনে ।এভাবেই আজ আরো জানার আগ্রহ ।

জেসি : তোমার আগ্রহের জন্য অভিবাদন । আশাকরি ভবিষ্যতে আলোচনায় আমরা আরো অনেক কিছু জানবো ।

ননী  : প্রায় দুইঘন্টা আমাদের এই কথোপোকথন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও ফলপ্রসু হয়েছে, জেসি, তোমার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ।

জেসি : হাঁ আমাদের দুজনের জন্যেই আলোচনা সমৃদ্ধিপূর্ণ, আমরা যোগাযোগের মাঝে থাকব, অনেক ধন্যবাদ তোমাকেও ।

 

- Advertisement -

Read More

Recent