শুক্রবার - মার্চ ২৯ - ২০২৪

লন্ডনের গল্পটল্প

দুবাই এয়ারপোর্টে বিরতি শেষে রওনা হয়েছে আবার প্লেন আর তিন ঘণ্টার যাত্রা বাংলাদেশে পৌঁছার। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির সাথে উত্তেজনা কাজ করছে তাতাইর মনে। মামা মামী, চাচা চাচী সবাই টানাটানি শুরু করবে তাতাইকে তাদের নিজের বাসায় রাখার জন্য। তাতাইর মতামতের কোনো দাম নেই। মুরব্বীরা যা বলবে তাই শুনতে হবে। অথচ মুরব্বীরা যে সূক্ষ রেষারেষি করছেন তাতাইকে নিয়ে সেটা মনে হয় ওরা বুঝতে পারেন না। তবে তাতাই ঠিক বুঝে ফেলে। সবাই নিজেদের মতন ভালো আছেন কিন্তু তাতাইর মা-বাবার কাছে আরো ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতাটা কেন তাতাই বুঝতে পারে না। তাতাই এবার যেখানে ভালোলাগে, যেভাবে ভালোলাগে থাকবে। মামার বাসায় ওর বেশি ভালোলাগে। মামার বাসায় সাজিদ ভাই আছে তাকে তাতাইর খুব পছন্দ। সাজিদ ভাইও তাতাইকে অনেক আদর করে। খুব ভালো গান করে সাজিদ ভাই। লন্ডনে এসেছিল একবার গান করতে। ছেলেমেয়েরা দারুণ ভক্ত সাজিদ ভাইর আর ওর গানের। ওর গাওয়া গান মুখে মুখে ফেরে। গত সামারে সাজিদ ভাইয়ের গানের অনুষ্ঠানগুলোতে তাতাই সাজিদকে নিয়ে গিয়েছিল লন্ডন এবং লন্ডনের আশেপাশের বিভিন্ন শহরের অনুষ্ঠানে। হাজার হাজার মানুষ ভেঙে পড়েছে। বিদেশে সারা জীবন থেকেও মানুষরা দেশের জন্য পাগল, বাংলা গানের জন্য পাগল। বিষয়টা তাতাইর মনে বিশাল রেখাপাত করেছে। কত যে ভক্ত সাজিদ ভাইয়ের। ঐ গানের অনুষ্ঠানের পর থেকে তাতাইর মনে বাংলাদেশে যাওয়ার আগ্রহটা বেড়েছে, সাথে নানুর কথা মনে পড়ছে।
জয় ঘুমাচ্ছে মনে হয়। চোখ বন্ধ করে আছে অনেকক্ষণ। অদ্ভুত মানুষটার জীবন। বিদেশি মা-বাবার কাছে আদরে সোহাগে বড় হয়েও ফিরে যাচ্ছে জন্মদাত্রী মাকে খুঁজতে। একেই কি বলে নাড়ীর টান। ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখেও অচেনা শ্যামলা মায়ের অবয়ব মুছে দিতে পারেনি ফর্সা মা। কত বয়স জয়ের? বাহাত্তরে জন্ম হলে এখন দুই হাজার দশে আটত্রিশ বছর বয়স ওর। এত বয়সে ওর সংসারে কে আছে তাতো বলল না। মা-বাবা আর বোনের কথা বাদে।
আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠল জয়।

- Advertisement -

─ মিটমিট করে তাতাইর দিকে দেখে হাই তুলতে তুলতে বলল,
─ কি ঘুমাওনি তাতাই?
─ না ঘুম এলো না।
─ একটু চা পান করতে হবে ডাকো না ওদের জোর গলায়।
তাতাই হাসে জয়ের দুষ্টুমি বুঝে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কোথায় এয়ার হোস্টেস।
পেছনে বসা এয়ার হোস্টেসের কাছে চায়ের কথা বলে আসে তাতাই। একটু হেঁটে এসে ভালো লাগে ওর।
─ জয় তুমি বিয়ে করেছো?
─ না, সেই পর্ব বাকি আছে, একটা সম্পর্ক ছিল ইউনির শেষ দিনগুলোয় খুব জোর প্রেম চলছিল। বিয়ের সব ঠিকঠাক, হঠাৎ মেয়েটা জানাল বিয়ে করতে নাকি ওর ভালো লাগছে না, বিয়ে করতে চায় না এখন। নরওয়ে ছেড়ে চলে গেল আমেরিকায়।

আমি ভেঙে পড়লাম খুব কিছুদিন। তখন আমার মা আমাকে ছোট শিশুর মতন ভালোবাসা দিয়ে আবার সচল করল। বোনগুলোও ঘিরে থাকত সারাক্ষণ।
─ তুমি আর কোনো সম্পর্ক করার কথা ভাবনি?
─ ঠিক তা নয়, হয়ে উঠেনি।
অচেনা মেয়েটার উপর রাগ করতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে তাতাই।
কি হলো?
– আমিও একজনকে এমন না করেছিলাম।
– তাই বড় চোখ করে তাকায় জয়, সাথে বলে কেন?
– আমার বয়স ছিল চৌদ্দ তখন, মনে হলো আমার ওকে ভালো লাগে না।
– তাহলে ঠিক আছে, তোমার বোধ-বুদ্ধি তেমন পরিণত ছিল না তখন।
– তাহলেও আমার মনে হয় আমি যা চাই আমি তাই করেছি। কারো সাথে জড়িয়ে জীবন খাঁচায় পুরে ফেলার চেয়ে এমন মুক্তবিহঙ্গ ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো অনেক আনন্দের আমার কাছে।
– তুমি তবে বন্ধনহীন।
– বন্ধনহীন মুক্ত স্বাধীন চিত্ত মুক্ত বনতলÑগুনগুন করে উঠে তাতাই। এই গানটা আমার এক কাজিন আছে সাজিদ তার কাছ থেকে শিখেছি। তোমার মতন বয়স হবে, পরিচয় করিয়ে দিব দেখবে ভালো লাগবে।

ঢাকার মাটি ছুঁয়েছে প্লেন। সব মানুষ অস্থির উন্মাদনায় দাঁড়িয়ে পড়ছে প্লেন থামার আগেই। বারবার ওদের স্থির হয়ে বসে থাকার আবেদন জানাচ্ছে এয়ার হোস্টেস। দেশের মাটি ছুঁয়ে ফেলার প্রিয়জনের মুখ দেখার অপেক্ষা আর সইছে না কারো দু’মিনিটের জন্য। বেশিরভাগ যাত্রী দুবাই থেকে উঠেছে হয়তো প্রথমবারের মতন বাড়ি ফিরছে, তাই উত্তেজনা অনেক বেশি। ধীরে সুস্থে নামে ওরা দু’জনে প্লেন থেকে। ইমিগ্রেশন পাড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। তাতাইর বাড়ির লোকজন সব দাঁড়িয়ে আছে সামনে ভিড় করে। অধীর আগ্রহে আপেক্ষা। কেউ আবার ফুল হাতে নিয়ে এসেছে। তাতাইর হাতভর্তি ফুল, কোলাকুলি, সালাম, কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত তাতাই এগিয়ে যায় ভিড়ের সাথে কথা বলতে বলতে। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে পড়ে আনমনে। হঠাৎ মনে হয় আরে জয় কোথায়? গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভিতরে যেয়ে খুঁজে তাতাই। না জয় নেই। মন খারাপ হয়ে যায় তাতাইর।
এত ভিড়ের মাঝে প্রিয় মানুষের মুখ নেই। সাজিদ ভাই বা লিমা আপা আসেনি। বড় চাচা ছোট ফুপুর ছেলে-মেয়ে ছোট চাচা আর মামী এসেছেন। তাতাইকে সবাই তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। আমাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি যেন এক প্রতিযোগিতা। তাতাই সিদ্ধান্ত দেয় আমি এখন মামার বাড়ি থাকব কিছুদিন। পরে সবার বাড়িতে যাবো। মামীর সাথে একা গাড়িতে বসে জয়ের জন্য কষ্ট হতে থাকে তাতাইর।
লিমাপা, সাজিদ ভাইর কথা জিজ্ঞেস করে। মামী ছোট করে বলেন, সবাই ভালো আছে।
মামী যেন অন্যবারের চেয়ে খানিক গম্ভীর।

লিমাপা, সাজিদ ভাই, মামা কেউ বাড়ি নেই। মামী বললেন, তাতাই তুমি গোসল করে খেয়ে রেস্ট করো। ওরা আসতে রাত হবে, ততক্ষণ তোমার ঘুম হয়ে যাক একটা।
তাতাই খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ল ভর-দুপুরে তবে ওর মন জুড়ে অনেকক্ষণ রইল জয়। মানুষটা কি হারিয়ে গেল নাকি আবার দেখা হবে কোথাও কখনো।

কি রে মামনি খালি ঘুমাবি, নাকি লন্ডনের গল্পটল্প বলবি না? মামার হাঁকডাকে উঠে তাতাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ন’টা। লম্বা ঘুম হয়েছে, শরীর ঝরঝরে লাগছে। গল্পে খাওয়া-দাওয়ায় রাত সাড়ে এগারোটা। লিমা আপা, সাজিদ ভাই কেউ বাড়ি ফিরল না। মামা-মামী নিজেদের মতন খেয়ে-দেয়ে শুতে গেলেন। মামার অনেক সকালে বেরিয়ে যেতে হবে। তাতাই টেলিভিশন চালিয়ে বসে আছে। ঘুম আসছে না। ঢাকায় এখন অনেক চ্যানেল। একটার পর একটা বদল করছে, কোনো অনুষ্ঠান ভালো লাগছে না। রাত প্রায় একটার দিকে শুয়ে পড়ল তাতাই। এপাশ-ওপাশ করে ঘুম জড়িয়ে আসছিল চোখে এমন সময় গাড়ির শব্দে ঘুম ছুটে গেল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল লিমা আপা নামছে একটা গাড়ি থেকে। কেউ একজন নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। একটু অবাক তাতাই! এতো রাত করে লিমাপা বাড়ি ফিরে ঢাকা শহরে। কারো কোনো উদ্বিগ্নতা নেই। ঢাকা তো বেশ উন্নত হয়েছে। মা যে বলল, ঢাকায় বাইরে চলাফেরায় অনেক ঝামেলা। হাসে তাতাই। এসো মা দেখে যাও তোমার ভাইয়ের মেয়ে রাত দুপুরে বাড়ি ফিরছে ঢাকায় কোনো অসুবিধা নেই। উপর থেকে ডাকে তাতাই,
─ হাই লিমা আপা।
─ কে রে তাতাই তুই এসেছিস, কেমন আছিস? কাল কথা হবে কেমন।
লিমা আপা জড়িয়ে কথা বলছে, সেকি ড্রিংক করে এসেছে? তাতাই ভাবে বাব্বা লন্ডনে আমি ড্রিংক করলে তো মা মার দিবে, ঢাকায় দেখি সব ফ্রী।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent