বুধবার - এপ্রিল ২৪ - ২০২৪

স্বপ্নপূরীর এই দেশ

ছবিইগুনে আকিমভ

এর পরের ঘটনা ভিন্নতর।

এতো বছর পর বন্ধু বন্ধুর মেসেজ পেলে সাধারণতঃ যেমনটি হয় এক্ষেত্রে সে রকম কিছুই ঘটেনি। বরং দিনের পর দিন মেসেজ রেখে যাচ্ছি নিজের পরিচয় দিয়ে কিন্তু প্রত্যুত্তর মিলছে না কিছুতেই। তাহলে কি নম্বরটি ভুল? নাকি সময়ের ব্যবধানে নিকট বন্ধুর সব অস্তিত্ব মুছে গিয়েছে অন্য বন্ধুর স্মৃতি ভাÐার থেকে। আমিও নাছোড় বান্দাÑ ভাবটা এমন যে, যেভাবেই হোক রহস্যের ক‚ল কিনারা একটা করেই ছাড়ব। ভেবে ভেবে ক্লান্ত এক বিকেলে হঠাৎ ফোনে পেয়ে গেলাম নিশুকে।

- Advertisement -

এতো বছর পর যোগাযোগ হওয়ায় আমি অভিভূত কিন্ত নিশু খুবই স্বাভাবিক।

সে সবই চিনছে, বুঝছে এবং স্মরণ করতে পারছেÑ কিন্তু মোটেও উদ্বেলিত নয়। বললাম কেমন আছো? খুব স্পষ্ট উত্তরÑ ‘ভালো নেই’। আমার কৌতূহল বাড়তেই থাকে। সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে স্বপ্নপূরীর এই দেশ কানাডায় এসে ভালো নেই কেন এরা? দুজনেই মেধাবীÑ দেশে যথেষ্ট ভালো চাকরি ছিল, ছিল ভালো অবস্থান।

কিন্তু তবুও ভালো নেই কেন? এটা কি শুধু বলার জন্যই বলাÑ নাকি অন্য কিছু?

এরপর সময় গড়িয়েছে অনেকÑ নিশুর কাছ থেকে শোনা হয়েছে অনেক জানাÑ অজানা অনেক গল্প। নিশু ইদানিং গল্প শুরু করলে আর শেষ করতে চায় না। আজ ওর মনে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক ভয়াল দিনের কথা। লোমহর্ষক সেই দিনটির কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে আমারও।

আমি তখন শাহজালাল হলের তিন তলায় থাকি।

দুই সিটের রুমÑ এক সিটে আমি আর অন্য সিটে ফিজিক্সের লোকমান। ক্লাশ থেকে ফিরে নাবা-খাবা শেষ। আমি বরাবরই একটু আয়েশি, তাই বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুম আসছে না আজ রুম-মেট লোকমানের উৎকণ্ঠা দেখে। সে তখনকার সময়ের প্রভাবশালী এক ধর্ম ভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। লোকমান আজ শুধু পায়চারি করছেÑ একবার রুমে ঢুকে তো আর একবার বারান্দায় যায়। হঠাৎ আমকে কাছে এসে ফিসফিস করে বললÑ

: অবস্থা ভালো নাÑ নতুন বাংলার হামিদ গ্রæপ কখন যে কি করে বলা যায় না। আমার নোটগুলি আপাততঃ তোমার ওয়াড্রোবে রাখছিÑ তালা দিয়ে রাখো। তুমি তো কোন দল করো না, তাই তুমি নিরাপদÑ সমস্যা যদি হয়, হবে আমার।

আমি ভাবছি লোকমানের মাথায় কোন সমস্যা না তো?

নাহ! সমস্যা লোকমানের মাথায় নয়, সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়।

আর সেটা বুঝতে পারলাম তখন, যখন শুনতে পেলাম ভয়ানক মুহুর্মুহু: বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ। বোমা ফুটছে আর ফুটছেÑ আওয়াজ আসছে সবগুলো হল থেকেইÑ মনে হচ্ছিল একাত্তরের কোন একটি ভয়াল দিন। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে আকাশে কোন বোমারু বিমান নেই। আমি ভয়ে নিজের রুম ছেড়ে আশ্রয় নিলাম হিমুর রুমে। জড়সড় হয়ে প্রচÐ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকলাম দু’জনÑ প্রায় আধঘণ্টা বিরামহীন বোমা আর গোলাগুলির শব্দ শেষে থামল যুদ্ধ। কি হয়েছেÑ কেন এই যুদ্ধÑ কার সাথে কি যুদ্ধ, বুঝিনি কিছুই। তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যখন ‘আল্লহু আকবর’ ধ্বনিতে আমাদের শাহজালাল হলের বারান্দায় মিছিল দেখতে পেলাম তখনই ঘটনা স্পষ্ট হলো। বুঝলাম লোকমানের আতঙ্কের কারণ এবং বিজয়ী কাফেলা কারা।

এতক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রÑ হামিদের ডান হাতের অর্ধেক কেটে নেয়া হয়েছে। সভাপতি সাহেব সোহরাওয়ার্দি হলের সামনের রাস্তায় নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের সভাপতি হামিদের সাথে কোলাকুলি করে মাত্র দু’ফুট দূরে গিয়েছেন। আর তখনই পাশের লেবু বাগানের ভিতরের অতি নিরাপদ অবস্থান থেকে গুলি আসে হামিদ এবং তাঁর সাঙ্গদের উপর। আধঘণ্টার এক বিরামহীন যুদ্ধে সমাপ্ত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্দান্ত প্রতাপশালী হামিদের রাজত্ব। দখল হয় সব ক’টি হল। এভাবেই এক রাজত্ব শেষ হয়ে অন্য এক মহা-পরাক্রমশালী একনায়কতান্ত্রিক নতুন রাজত্বের সুচনা হয়। শেষ হয় ভাগযোগের রাজনীতিÑ যা চলছে আজও, হয়ত চলবে অনাদিকাল। পরিবর্তন হয় শুধু রাজা আর রাজত্বের।

উইন্ডসর, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent