শুক্রবার - মার্চ ২৯ - ২০২৪

পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ঘরে

ছবিরে এস

দিন কয়েক পরে সাজিদ উত্তরা এলাকায় একটা বাসা ঠিক করে নিজের জন্য। বেশ খোলামেলা চারধার। ইউনিটের কোণার দিকের শেষ বাড়িটা ওর পছন্দ হয়। পেছনের দিকটা খোলামেলা। ধানী জমি, দূরে রেললাইন। দিগন্ত রেখায় আকাশ মাটিতে মিশে গেছে। গ্রামের পরিবেশ আছে মনে হয়।
একজন যুবক ছেলের একা বাসা ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে অনেক আপত্তি হয়। তবে আবেদিন আহমেদের নাম, পরিচিতি আর প্রতিপত্তিই কাজ করল বাড়ি পাওয়ার ব্যাপারে মনে হলো। তাছাড়া বাড়িওয়ালা বিদেশে থাকে সে হিসাবে বিদেশি মনোভাবই দেখাল। কার সাথে থাকবে, কীভাবে থাকবে এত সব প্রশ্ন তুলল না।
পনের দিনের মধ্যে সাজিদ চলে এলো নতুন অ্যাপার্টমেন্টে।

মা কোনো প্রশ্ন করেননি নিশ্চয়ই আবেদিন আহমেদ বুঝিয়ে বলেছেন। মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছেন আর বলেছেন মাঝে মাঝে যেতে। মিসেস আবেদিনও নিজের সন্তানের মতন গ্রহণ করেছেন ওকে। প্রথম দিনই বলেছেন আমাকে মা ডাকবে। কিশোর বয়সে সেই প্রথম একজনকে পেলো মা বলে ডাকার। প্রথম প্রথম ভিষণ লজ্জা পেতো সাজিদ কিন্তু মায়ের ভালোবাসা মা ডাকতে বাধ্য করেছে সাজিদকে।
লিমাকে কেউ কিছু বলেনি। নিঃশব্দ এক বোঝাপড়া যেন তিনজনের মাঝে। লিমা তখন বাইরে, ওর অজান্তে সাজিদ আবাস পরিবর্তন করে চলে যায়।
একটা সুটকেসে পরনের কাপড়, বইখাতা। সকল বাদ্যযন্ত্র। সব কিছু সাফ করতে গিয়ে ঘরের কোণে পেয়ে গেল বাদশা মিয়ার কুঁড়ে থেকে আনা টিনের ট্রাংক আর কাপড়ের পুঁটলিতে বাঁধা এস্রাজ। এই সম্পদ সাথে করে সাজিদ ওর নিজের ঘরে উঠে এলো।
অনেকদিন একটা পরিবারের মায়ায় জড়িয়ে থেকে যে অভ্যাসগুলো জন্মেছিল তা অকারণ মন খারাপ করে দিচ্ছিল। দক্ষিণের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় বসে থাকল অনেকক্ষণ। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ঘরে ঢুকে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা জিনিসগুলো পাশে সরিয়ে রাখল। পুরনো কাপড়ে পেঁচানো এস্রাজটা খুলে টুং টাং তাল তুলল খানিক, সুর বাঁধতে হবে। বাদশা মিয়ার হাতের ছোঁয়া যেন পেল সাজিদ।
কেন গান গাওয়া বন্ধ করল বাদশা? কোনোদিন গুন গুন করতেও শুনেনি সাজিদ। কি ভীষণ মারত সাজিদকে গান গাইতে শুনলে? কী দুঃখে গান ছেড়েছিল জানা যাবে না কখনও নিজেকে প্রশ্ন করে সাজিদ। বয়স এমন বেশি কিছু ছিল না। এমন হুট করে মরে গেল কেন? কি অসুখ ছিল? পাশাপাশি থেকে কখনও জানেনি সাজিদ। জানতে চায়ওনি কখনও। দুঃখ হতে থাকে ওর বাদশা মিয়ার জন্য। যে মানুষটা তুলে না আনলে ও হয়তো হারিয়ে যেত অথবা কি জানি কেমন হতো অন্যজীবন নিজের বাবা-মার কাছে থাকলে। আনমনা সাজিদ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে মেঝেতে, পাশে রাখা এস্রাজটার উপর হাত। মনে হয় যেন ঘুমের মাঝে জড়িয়ে আছে বাদশা মিয়াকে। আচ্ছা এই টিনের বাক্সে কি আছে? কোনো মূল্যবান কিছু আছে ভেবে সাথে নিয়ে এসেছিল ঢাকায়। সারা জীবন ঐ বাক্স দেখেছে বাদশা মিয়ার ঘরে কিন্তু তাকেও কখনো খুলতে দেখেনি। কোনোদিন খুলে দেখা হয়নি কি আছে ভিতরে। ঢাকায় আসার পর ব্যস্ততার জীবনে, নিজেকে গড়ার জীবনে ভুলেই গিয়েছিল এই টিনের বাক্সের কথা।

- Advertisement -

আচ্ছা কি আছে এর ভিতর আজ দেখব। উত্তেজনায় উঠে বসে সাজিদ। ছোট্ট একটা তালা আটকানো জং ধরা, চাবি কই? চাবি কখনও ছিলই না সাজিদের কাছে। জোরে মোচড় দিতেই ভেঙ্গে গেল তালাটা। তালার চেয়ে শক্ত হয়ে লেগে আছে হুড়কা। বেশ সময় টানাটানি করার পর খুলল। আস্তে আস্তে ডালাটা তুলল সাজিদ যেন নতুন বউয়ের ঘোমটা খুলছে। একখানা সবুজ রঙের ফুলতোলা নকশা করা কাপড় ট্রাংকের জং লেগে হলুদ হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় হলুদ রং বেশ গাঢ়। কাপড়টা নরম হাতে তুলল সাজিদ। ফুলের মাঝে লেখা আছে ‘তুমি কিন্তু বন্ধু মোর রেখো মোর স্মৃতি’। নিচে একখানা লাল শাড়ি ব্লাউজ। একটা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি, খয়েরি রঙের পশমি শাল কাশ্মিরি করুকাজ করা। প্রচণ্ড শীতের সময় আগুনের পাশে বসে তাপ নিত বাদশা মিয়া কিন্তু এই শাল কখনও গায়ে দেয় নি। এগুলো কি ওর বিয়ের বস্ত্র? গোলাপী একটা সিল্কের রুমালে কিছু বাঁধা আছে। বাঁধন খুলে দেখল ক’গাছি কাচের লাল চুড়ি, দু’টি কানের পাশা মনে হলো সোনার। কালো তাগায় বাধা কণ্ঠি। একটা খাতায় মনে হলো গান লেখা। বেশির ভাগ লেখা মুছে গেছে। খাতার নিচে ছিটের একটা ফুলতোলা ফ্রক। তাহলে বাদশা মিয়ার ছেলে ছিল না মেয়ে ছিল? ফ্রকটা চোখের সামনে মেলে ধরে ভাবতে লাগল সাজিদ। জীবন কত বিচিত্র। মেয়ে রেখে আরেকজনের ছেলে তুলে নিয়ে এলো বাদশা মিয়া। সারা জীবন কি সেই দুঃখই বয়ে গেছে? অন্ধকার হয়ে এসেছে। উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিল সাজিদ। থাক, একজনের সম্পত্তি আমানত গুছিয়ে তুলে রাখি। এগুলোর মালিক আমি ওর আর কেউ ছিল নাতো। এমন সময় চকিতে মনে হয় নাকি ওর মেয়েটা অন্য কারো কাছে বেঁচে আছে আমার মতন। হয়তো আমার মা-বাবার কাছে। কথাটা ভেবে বেশ আরাম পায় সাজিদ। তাহলে সব শোধবোদ হয়ে গেল।

গুছিয়ে সব তুলে রাখতে গিয়ে ট্রাংকের ভিতর আরো কিছু আছে আলোয় দেখতে পায় সাজিদ। একসাথে মুঠো করে তুলে আনে সব। একটা ছোট ছেলের জামা প্যান্ট ছোট একজোড়া জুতা মোজা। এগুলো কি তবে আমার? নাকের কাছে জামাটা ধরে ঘ্রাণ নেয় সাজিদ অনেকক্ষণ ধরে। কই মাঝে মাঝে হাওয়ায় ভাসা সেই ঘ্রাণটার মতন কিছু পায় না, শুধু পুরনো গন্ধ। বন্ধ বাক্সের টিনের গন্ধ পায় সাজিদ। শার্টটা মেলে ধরতে ভিতর থেকে কিছু নিচে পড়ে টং করে শব্দ হয়।
একটা চেইন বেশ ভারি লকেটসহ। লকেটে লেখা আছে আল্লাহ।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent