শুক্রবার - এপ্রিল ২৬ - ২০২৪

এক্কৈবারে লইযাও আঁরে আঁই তো রাজি অ সুন্দর মানু…

সুভাষ দত্তের বসুন্ধরা সিনেমায় শেফালি ঘোষের কণ্ঠে একটা গান ছিলো পাহাড়ি এক নারী চরিত্রের অভিনয়শিল্পীর লিপে। সেই পাহাড়ি মেয়ের বিপরীতে চারুকলার ছাত্র চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছিলেন ঝাঁকড়া চুল আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সমৃদ্ধ নবীন এক তরুণ। শরীর স্বাস্থ্যে টিংটিঙে সেই তরুণের নামটাও ছিলো অন্য রকম–তিমুর। চরিত্র অনুযায়ী দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তরুণটি। এর আগে বা পরে তাঁকে আর কোনো চলচ্চিত্র কিংবা টিভি নাটকে আমি দেখিনি।

- Advertisement -

আমি গানে পাওয়া মানুষ বলে বসুন্ধরা চলচ্চিত্রের দুর্দান্ত কয়েকটা গান আমার হৃদয় অধিকার করে নিয়েছিলো প্রথম দর্শন এবং শ্রুতিতেই। তখন একটা সিনেমা ভালো লাগলে বা সিনেমার কোনো একটা গান ভালো লাগলে সেই সিনেমাটা আমাকে দেখতে হতো বারবার। শৈশব তারুণ্যে আমার অন্যতম প্রধান বিনোদনই ছিলো সিনেমা আর গান।

আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নাম্বার তৈলচিত্র’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘বসুন্ধরা’ সিনেমার অন্যতম সম্পদ ছিলো সত্য সাহা সুরারোপিত গানগুলো।

বসুন্ধরায় সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া গাজী মাজহারুল আনোয়ারেরলেখা–রঙধনু ছড়িয়ে চেতনার আকাশে আসে/ আর ভালোবাসে…গানটিও ছিলো দারুণ। চারুকলা ইনস্টিটিউটের পেছন ক্যাম্পাসের গোলপুকুরটিকে ঘিরে স্লো মোশনে দৌড়ে দৌড়ে গানের দৃশ্যটিতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। ববিতার সঙ্গে ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। বসুন্ধরা ছিলো কাঞ্চনের প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র।

আর্টিস্ট হতে চেয়েছিলাম বলে, প্রচুর একজিবিশন দেখতাম বলে, চারুকলার ছাত্র হতে চেয়েছিলাম বলে, চারুকলা ভবনের টিচার্সরুম-বারান্দা-বাগান-করিডোর-সিঁড়ি-ছাদ-বকুলতলা কিংবা সেই গোল পুকুরটার প্রতি ছিলো আমার দুনির্বার আকর্ষণ। বহু দুপুর আমি একলা একা ঘুরে বেরিয়েছি চারুকলার এইপ্রান্ত সেইপ্রান্ত, অন্ধিসন্ধি। মধুমিতা হলের বড়পর্দায় ‘রংধনু ছড়িয়ে চেতনার আকাশে’ গানটি যখন দৃশ্যমান হলো–মুহূর্তেই লোকেশনটা আমি চিনে নিয়েছিলাম–ওটা চারুকলায় শ্যুটিংকৃত!

বসুন্ধরায় ওস্তাদ আখতার সাদমানীর গাওয়া দুর্দান্ত ‘সা দানি দেরেনু

দেরে না দিন’…একটা ধ্রুপদী গানের সঙ্গে অসাধারণ একটা নৃত্যদৃশ্য সংযোজন করেছিলেন সুভাষ দত্ত। চিত্রনাট্যে একটা স্টেজশোর দৃশ্যে নৃত্য পরিবেশন করছিলেন চিত্রনায়িকা নূতন। ধ্রুপদী নৃত্যে নূতনের যে অপরূপ দক্ষতা ও পারদর্শিতা ছিলো তা আমাদের চলচ্চিত্রের কোনো পরিচালকই শনাক্ত করতে পারেননি বা বুঝতেইপারেন নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সুভাষ দত্ত। ধ্রুপদী সঙ্গীতের বোল আর তবলার অপরূপ ছন্দ মাধুর্যের সঙ্গে নূতনের অনবদ্য নৃত্যশৈলী বসুন্ধরাকে দিয়েছিলো অনন্য মর্যাদা। পরবর্তীতে একটি অনুষ্ঠানে নূতনের সঙ্গে আমার দেখা হলে বসুন্ধরা সিনেমায় তাঁর অসাধারণ নৃত্য নৈপূণ্যের কারণে তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলাম অকপটে। বলেছিলাম আমাদের চলচ্চিত্র আপনার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। যোগ্যতা অনুযায়ী আপনার আসনটি আপনি পাননি। যা আপনার প্রাপ্য ছিলো। শুনে তিনি একই সঙ্গে আনন্দিত এবং ব্যথিত হয়েছিলেন। আনন্দিত হয়েছিলেন এই কারণে যে দেশের একজন পরিচিত লেখক-ছড়াকার তাঁর নাচের প্রশংসা করছেন। আর ব্যথিত হয়েছিলেন এই কারণে যে বসুন্ধরা সিনেমায় তাঁর সেই ক্লাসিকেল ডান্সের কথা চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কেউ আলাদা ভাবে উচ্চারণও করেননি কোনোদিন! চলচ্চিত্র পরিবারের কোনো একজনও বলেননি তাঁকে সেই নৃত্যদৃশ্যের কথা। দীর্ঘদিন পর চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত নন এমন একজনের কণ্ঠে সেই পারফর্মেন্সের

প্রশস্তি শুনে ভীষণ আবেগতাড়িত হয়েছিলেন নূতন। চিকচিক করছিলো অশ্রুবিন্দু তাঁর অপরূপ দুই কাজলটানা চোখের কোণে। একজন প্রকৃত শিল্পী তো এমনই হবেন।

স্মৃতিগদ্যটি শুরু করেছিলাম বসুন্ধরার প্রিয় একটি গানের প্রসঙ্গের অবতারণা করে। শিরোনামেও ব্যবহার করেছি সেই গানের একটি চরণ–এক্কৈবারে লইযাও আঁরে আঁই তো রাজি অ সুন্দর মানু…।

১৯৭৭ সালের শেষ দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত বসুন্ধরা সিনেমাটি দেখেছিলাম পাঁচ থেকে সাত বার। কি ছবি বানাইবা তুঁই আঁই ন বুঝি গানটি আমার স্মৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে গেঁথে আছে সেই থেকে। নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর ভরসা রেখে গানের কথাগুলো একবার লিখি বরং–

”এক্কৈবারে লইযাও আঁরে আঁই তো রাজি অ সুন্দর মানু মানুরে কি ছবি বানাইবা তুঁই আঁই ন বুঝি।/

তুঁই শুধু আইলা গেলা/ রংগর ঢংগর কতা কইলা/চিন্তা রোগর অষুদ ন দিলা/ ঘর বাড়ি ছাড়ি আঁই/তোঁয়ার অঙ্গে যাইতাম চাই/এতোদিনেক্যান্‌ ন নিলা/ রাইতে দিনে আর ফরানে তোঁয়ারে খুঁজি ও সুন্দর মানু, মানুরে…/

জোয়ার ভাটা বুকে লই/কর্ণফুলি যা রে বই/ দরিয়ারো প্রেমের কারণে/ ভরা যৈবন অংগে লই/ তোঁয়ার লাগি পাগল হই/ সইপা দিছি তোঁয়ার চরণে/ সইমু কত বিচ্ছেদ জ্বালা দুই নয়ন বুঁজি ও সুন্দর মানু, মানুরে…।

এরপর সময় গড়ায়।

আসে ১৯৮৯ সাল।

আমি কাজ করি দৈনিক খবর হাউসে। সাপ্তাহিক ছায়াছন্দ পত্রিকার প্রদায়কের চাকরি ছেড়ে তখন আমি একই হাউসের ‘সাপ্তাহিক মনোরমা’ পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। আমাদের অফিসটি শান্তি নগরে। শান্তিনগরের মোড় থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যেতে রাস্তার ডান পাশেই অফিসটা। কাজ করতে করতে মাথায় জ্যাম লেগে গেলে মাঝে মধ্যে রাস্তায় এসে দাঁড়াই। চলমান মানুষ দেখি। একেকটা মানুষের সঙ্গে হেঁটে যায় একেকটা ছোটগল্প। উপন্যাস। এক দুপুরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তার অপর প্রান্তের ফুটপাথ থেকে যুবক বয়েসী একজন মানুষ তাঁর লম্বা পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাসি হাসি মুখে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন–কেমন আছেন?

হ্যাণ্ডশেক করতে করতে মনে করতে চেষ্টা করলাম–চিনি কি না মানুষটাকে? কিন্তু নাহ্‌ কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আমার অবস্থা বুঝে সেই যুবক বললেন–আপনি আমাকে চিনবেন না রিটন ভাই। আমাকে চেনার কোনো কারণও নেই। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে আপনার অনেক ঘনিষ্ঠতা। তাঁর নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

আর আমি তিমুর।

তিমুর নামটা শুনেই ঝটিতি আমার মনে পড়ে গেলো বসুন্ধরার কথা–আরে! আপনি সেই তিমুর? বসুন্ধরার তিমুর? আরে আপনার সেই ঝাঁকড়া চুল কোথায় গেলো? আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িই বা উধাও কেনো? আর সায়ীদ স্যার আপনার বড় ভাই এটা তো জানতাম না! আমরা তো শুধু আল মনসুরের কথাই জানি! কী আশ্চর্য!

তিমুর বললেন, আশ্চর্য হবারই কথা। কোথাও তেমন যাই-টাই না যেখানে আপনারা থাকেন। একটু আড়ালে থাকতেই পছন্দ করি। অইযে কাছেই আমার অফিস। আপনাকে দেখে কেনো জানি না হঠাৎ মনে হলো একটা হ্যালো করে যাই।

এরপর তাঁর প্রতি আমি আমার সীমাহীন মুগ্ধতার কথা বললাম। তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ের কথা বললাম। তাঁর অভিনীত অনবদ্য কয়েকটা দৃশ্যের কথা বললাম। আর বললাম কি ছবি বানাইবা তুঁই আঁই ন বুঝি গানটার কথাও।

খুবই উচ্ছ্বল তরুণ এই তিমুর। খুব ভালো করে তাকালে তাঁর চেহারায় সায়ীদ স্যারের একটা রিফ্লেকশন টের পাওয়া যায়।

আজ বহু বছর পর অটোয়ার করোনাক্রান্ত গৃহবন্দিকালের বিষণ্ণ দুপুরে রুচিস্নি তরুণ তিমুরের কথা খুব মনে পড়ছিলো।

তিমুর আপনি কেমন আছেন?

বারো হাজার তিনশো কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডা থেকে আপনার জন্যে রাশি রাশিশুভ কামনা।

 

[পুনশ্চঃ ইন্টারনেটে খোঁজ দ্য সার্চ করে কোত্থাও তিমুর নামের সেই স্মার্ট তরুণ অভিনেতার কোনো ছবি খুঁজে পেলাম না। শেষে নিজস্ব দুর্বল তরিকায় ঝাপসা তিমুরকে বের করে এনেছি। কারো কাছে বসুন্ধরার ঝকঝকে কোনো স্টিল ছবি থাকলে আমাকে দেবেন প্লিজ।]

এ শহর তারও…

লুৎফর রহমান রিটন

এ শহর নয় তোমার একার।

এখানে সবার আছে অধিকার চলাচল আর বেঁচে থাকবার।

সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর গড ভগবান খোদা প্রাণ-প্রকৃতিতে তোমাকে রেখেছে,

বৃক্ষ রেখেছে, পাহাড় নদী ও জোনাকি রেখেছে,

বেড়াল-কুকুর-পাখি আর হাতি এমনকি এক গুবরে পোকারও সমানাধিকার বেঁচে থাকবার, তোমার মতোই।

কেনো তাকে তুমি উৎখাত করো তার চেনাজানা লোকালয় থেকে!

কেনো তাকে তুমি উৎখাত করো চেনাজানা তার শহর থেকে!

মেনে নিতে তুমি পারো বা না পারো, এ শহর তারও, এ শহর তারও।

মানুষের সাথে সখ্য তাদের, তুমি কি মানুষ?

কুকুরের সাথে শত্রুতা কেনো?

ওরা বোবা প্রাণি অসহায় বলে?

চোর-খুনি-আর লুটেরা সকল দুর্নীতিবাজ দু’পেয়ে পশুকে কিচ্ছু বলো না,

কিচ্ছু করো না।

কিন্তু তোমরা মানতে পারো না কুকুরের ছায়া

কুকুরের পিছে লেলিয়ে দিয়েছো নিঠুর ঘাতক!

ওরা করে নাই নগরের ক্ষতি,

গণমানুষের শত্রু না ওরা, তারপরও কেনো বিনাশ চাইছো!

অথচ তোমারই চোখের সামনে দু’পেয়ে পশুরা দিব্বি বহাল…

বন্ধ করো এ হত্যাকাণ্ড, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড

মানবিক হও প্রাণবিক হও…

 

 

পার্টি শেষে ভার্টিগো

লুৎফর রহমান রিটন

[উৎসর্গ/ জসিম মল্লিক এবং ডাক্তার আরিফুর রহমান প্রিয়জনেষু]

কাল সারারাত পার্টি ছিলো

আহ্‌ কী দারুণ পার্টি গো!

মধ্যরাতের আসর মানেই

জোক্‌স্‌গুলো কী ডার্টি গো!

রাম হুইস্কি বিয়ার শেষে

ভদকা খেলাম চারটি গো!

লম্বা ঘুমে দিন করে পার

হইলো শেষে ভার্টিগো!

আউলা ঝাউলা আকাশ-পাতাল

ব্যথায় কাতর ঘাড়টি গো!

চউক্ষে সর্ষে ফুলের বদল

দেখছি বাঁশের ঝাড়টি গো!

শুইয়া থাকি খাই আর ঘুমাই

য্যানো ধর্মের ষাঁড়টি গো!

পারছি না আর করতে বহন

নিজের মাথার ভারটি গো!

একলা একা কান্তে কান্তে

খাইতেছি কি মারটি গো!

অভাগাকে কে দেখাবে

ভব্‌দরিয়ার পাড়টি গো!

 

 

 

ওরে আমার মরার কোকিল…

লুৎফর রহমান রিটন

যখন আমি জন্মেছিলাম, প্রথম যখন দেখেছিলাম এই পৃথিবীর বর্ণালি রঙ, আলো

তখন আমার মাথায় ছিলো অল্পকিছু রেশমি নরম তুল তুল তুল চুলের বাহার, কালো।

দিনে দিনে বড় হলাম মাথার সে চুল ঝাঁকড়া হলো  ঝাঁকড়া সে চুল উড়লো হাওয়ায় দুলে

মধ্য বয়স পেরিয়ে যেতেই কী যে হলো! কী যে হলো! শাদার প্রলেপ লাগলো এসে চুলে।

ঝাঁকড়া চুলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে আহা রোজ প্রতিদিন চকচকে এক টাক উঁকি দেয় ক্রমে…

শুভ্র-শাদা চুলগুলো সব যাচ্ছে চলে আমায় ছেড়ে জানি না কোন ভ্রান্তি ও বিভ্রমে!

যখন প্রতিফলিত হই আয়নাতে রোজ বিষাদে মন যায় ছেয়ে যায়–মনটা কাঁদে উহু

প্রকৃতি হয় আরো সবুজ গাঢ় সবুজ। বসন্ত কাল। আমের মুকুল। কোকিল ডাকে কুহু…

কোথায় আমার বসন্ত গো! হায় রে আমার মরার কোকিল বিচ্ছেদে তোর অশ্রুতে যাই ভিজে

বৃদ্ধ হবার অপরাধে আমায় ছেড়ে যাস নে কোকিল! একদিন তুই বৃদ্ধ হবি নিজে…

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent