বৃহস্পতিবার - এপ্রিল ১৮ - ২০২৪

নতুন প্রজন্মের জন্যে

শুধুমাত্র ধর্মের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর মানচিত্রে পাকিস্তান নামক একটি দেশের অভ্যুদয় ছিল অনেকটা বিকলাং শিশু প্রসূত হবার মত ঘটনা। ধর্ম ছাড়া আর কোথাও পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোন মিল ছিল না। শুধুমাত্র ধর্ম দুটি ভিন্ন জাতিসত্ত্বাকে ঐক্যের বন্ধনে ধরে রাখতে পারে না।ভাষা, কৃষ্টি এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধান দুটি জাতিসত্ত্বার মধ্যে অমিলকে প্রকট করে তুলেছিল।

- Advertisement -

মূলত এই অমিলের সূচনা হয় ভাষাকে কেন্দ্র করেই।কারন, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল বাংলা।পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন উর্দু ভাষাভাষী পশ্চিম পাকিস্তান অংশের। তাই উর্দু ভাষার প্রতিই তার বিশেষ টান এবং দুর্বলতা ছিল বরাবরই।তিনি পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হিসাবে ১৯৪৮ সালের ১৯ শে মার্চ প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে আসেন।২১ শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সম্বর্ধনায় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।‘ এরপর ১৯৪৮ সালের ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পুনরায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন।গভর্নর জিন্নাহর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কার্জন হলে উপস্থিত ছাত্রদের একটি অংশ তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়। স্ম্ফুলিঙ্গ থেকে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, ক্ষীণ এ প্রতিবাদ থেকেও  তেমনি দেখা দেয় প্রতিরোধের শিখা। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে রাজপথের আন্দোলন।

কার্জন হলে প্রতিবাদকারীদের একজন ছিলেন ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন। ভাষা মতিন হিসেবে খ্যাত এই আন্দোলনকারী নিজের এক লেখায় ওই দিনের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর ভাষণ শুনতে সেখানে যাই। ভাষণে বললেন, ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। প্রতিবাদ করতে চাইলাম। বন্ধুরা থামিয়ে দিল। হলে এসে দেখি কনভোকেশনের নোটিশ। ২৫ টাকা দিয়ে ড্রেস নিলাম। ভাবলাম, সেখানে যদি জিন্নাহ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আবার বলেন, তবে প্রতিবাদ করব। এদিকে কথাবার্তা হচ্ছে জিন্নাহকে অপমান করা হলে বরদাশত করা হবে না। কার্জন হলে জিন্নাহ এলেন। সুন্দর চেহারা। চোস্ত ইংরেজি বলেন। বললেন, ওয়ান নেশন, ওয়ান লিডার, ওয়ান রুল, ওয়ান স্টেট ল্যাংগুয়েজ। কেউ কিছু বললেন না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, প্রতিবাদ করলাম। আমি প্রথম ‘নো’, ‘নো’ বলে প্রতিবাদ করি। আমার প্রতিবাদের সাথে সাথে অনেকে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।”

এ প্রসঙ্গে ভাষা সংগ্রামী ডা. আহমদ রফিক বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথে এ ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জিন্নাহর বক্তৃতা ছাত্রসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিক্ষুব্ধ কিছু ছাত্র রেসকোর্স ময়দান থেকে বেরিয়ে এসেই ক্ষান্ত হননি, জিন্নাহ-বন্দনায় তৈরি বেশ কয়েকটি তোরণ ভাংচুর করেন। তারা জিন্নাহর ছবি নষ্ট করেন। এ ঘটনা তখনকার জন্য অভাবিত। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে একাত্তরের মার্চে।( সূত্রঃদৈনিক সমকাল)

তবে বাংলা ভাষার দাবিতে সর্বপ্রথম অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলীর জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবী নাকচ করে দেন।

কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে ‘নো নো’ বলে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় তারই ধারাবাহিকতায় আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি।

বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশের জনগন মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রান দিয়েছিল। মূলত ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিল।

আজ ডেনফোর্থে ভাষা শহীদদের বেদিতে ফুল দিতে এসে মনে হলো নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়ত ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাসটুকু বিস্মৃত হয়েছেন কিংবা অনেকেই এর সঠিক ইতিহাস জানেন না, তাই এই লেখার মাধ্যমে তাদের কাছে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের ইতিহাসটুকু তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। প্রবাসী প্রথম প্রজন্মের গুরু দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাসটুকু পৌছে দেওয়া।

ভাষা শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। বাংলা ভাষার জয় হোক।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent