শুক্রবার - মার্চ ২৯ - ২০২৪

পরাণের পোস্টমর্টেম

গতকাল টরন্টোর এগ্লিন্টন সিলেপ্লেক্সে রিলিজ হওয়া “পরাণ” সিনেমাটি দেখলাম।

- Advertisement -

প্রিয়জনদের সাথে সিনেমাটি দেখার আনন্দ ছিল অন্যরকম। বিশেষ করে সিনেমা শেষে সিনেমাটি নিয়ে

সবার সাথে আলাপ-আলোচনায় অনেকের মতামত উঠে এসেছিল। সবার একটা ছোটখাটো রিভিউ পাওয়া গিয়েছিল। সবার সাথে সিনেমা দেখার মজা এখানেই।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি উপভোগ্য ছিল। বিশেষ করে শরিফুল রাজের অভিনয় চোখে পড়ার মতো ছিল। তার অভিনয় গুনেই ‘পরাণ” সিনেমাটি দর্শক মহলে প্রসংশিত হয়েছে। অন্যান্যদের অভিনয়ও বেশ ভালো ছিল। প্রতিটি চরিত্র কালাকুশলিদের  অভিনয় শৈলীর কারনে বেশ ফুটে উঠেছিল।রোমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ভূমিকায় রাশেদ মামুন অপুর অভিনয় দর্শকদের অনেক হাস্যরসের জোগান দিয়েছে।  সিনেমাটিতে শরিফুল রাজের পর কাউকে যদি অভিনয়ে ভালো নাম্বার দিতে হয় তবে সেটি অবশ্যই বিদ্যা সিনহা সাহা মীমের পাওয়ার কথা।

শরিফুল রাজ “রোমান” চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে সিনেমাটি দেখার পর যে কোন দর্শকেরই রোমানের প্রতি এক ধরনের সহানূভুতি জন্মানোর কথা। রোমান চরিত্রটি যদি বাস্তবে বরগুনার নয়ন বন্ড হয়ে থাকে তবে তার কোন প্রকার সহানূভুতি পাওয়ার অবকাশ থাকার কথা নয়।

নয়ন বন্ড জিবিত থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে মাদক, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী এবং ছিনতাইয়ের ১০টি মামলা ছিল।

“০০৭ বন্ড গ্রুপের’ প্রধান নয়ন বন্ড : সহযোগী সন্ত্রাসীদের নিয়ে গঠন করা একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম ‘০০৭ বন্ড গ্রুপ’। এই গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরাজী আর লিডার হচ্ছে সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড।

জেমস বন্ডের আদলে গড়া এই সন্ত্রাসী গ্রুপের শেষ শব্দ বন্ডের সঙ্গে মিলিয়েই নিজের নামের পেছনে বন্ড লাগিয়েছে নয়ন।”(যুগান্তর)

এই যদি হয় বাস্তবের নয়ন বন্ড, তবে কেন ‘পরাণ’ সিনেমায় রোমানের চরিত্রে দর্শকদের কাছে সহানূভুতি পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে? সে তো বাস্তবে ঘৃণার পাত্র ছিল।রোমানের প্রতি দর্শকদের সহানূভুতি নির্মম হত্যার শিকার সিফাতের প্রতি সহানূভুতিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। আমার কাছে এটিকে সিনেমার দুর্বল দিক বলে মনে হয়েছে।

অবশ্য সিনেমাটির বিষয়ে নির্মাতা রায়হান রাফি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘একটি সত্য ঘটনা থেকে তিনি উৎসাহ পেয়েছেন পরাণ সিনেমা নির্মাণের। তবে সিনেমাটি বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ড বা মিন্নিকে নিয়ে নয়।’

কিন্তু সিনেমাটি দেখার পর এমন কোন দর্শক বাকী নেই যে বলছে না যে, এই সিনেমার সাথে রিফাত হত্যা ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। প্রতিটি দর্শক বলেছেন, এই সিনেমাটি রিফাত হত্যাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে।

নির্মাতা রায়ান রাফি এই বিষয়টি অস্বীকার করতে পারবেন না ।

‘অনন্যা’ ভূমিকায় বিদ্যা সিনহা মীমের অভিনয় ভালো ছিল। সিনেমায় অনন্যা চরিত্রটিকে যেভাবে রূপায়ন করা হয়েছে তা অনেকের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়নি। দর্শকদের কাছে অনন্যা প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক হিসাবে   চিহ্নিত হয়েছে। রোমানকে সে রাজনীতি এবং মাদক ছেড়ে দেওয়ার শর্তে তার সংগে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু  সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে সে উল্টো রোমানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। আর সিফাতের মতো ভদ্র-নম্র ছেলেকে কাপুরুষ, মেরুদণ্ডহীন বলে তার মধ্যে প্রতিবাদ করার স্পৃহা জাগিয়ে তোলে এই অনন্যাই । ঠিক এই কারনেই সিফাত রোমানকে বাঁধা দিতে গিয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়। সিনেমার শেষের দিকে দেখা যায়, অনন্যার প্ররোচনার কারনেই রোমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রোমানকে গুলি করে হত্যা করে।

এই সব কারনে ‘পরাণ’ সিনেমার অনন্যা চরিত্রটি নারী আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত তাদের কাছে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষনের দাবী রাখে।

কারন, ‘অনন্যা’ চরিত্রটিকে অনেক দর্শক বাস্তবের মিন্নির সাথে তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছে। যার কারনে বাস্তবে মিন্নিকে সবাই  আরো নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

পত্রিকা থেকে জানা যায়,

“রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। আদালতের আদেশের পর বরগুনা জেলা কারাগার থেকে মিন্নিকে নেওয়া হয় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে। সেখানে কনডেম সেলে অবস্থান করছেন মিন্নি।”

দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি এখনো বিচারাধীন রয়েছে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মিন্নি উচ্চতর আদালতে আপিল করেছেন। মূলত: মিন্নি ছিলেন এই মামলার মূল সাক্ষী। মূল সাক্ষী থেকে কিভাবে মিন্নি মূল আসামীতে পরিনত হলো সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। এর পরেই মিন্নি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় যা আদালতে পরে পাঠ করে শোনানো হয়।

মিন্নির বাবা ইতিমধ্যে অভিযোগ করেছেন, এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি মিন্নির কাছ থেকে জোর করে আদায় করা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, যে ভিডিওর কারনে রিফাত হত্যা সেই সময় বিপুল আলোচিত হয়েছিল সেই ভিডিওটি আদালত আমলে নেয়নি। এই ভিডিওটি ভাইরাল হবার কারনেই মানুষ এই হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। এই মূল বিষয়টি আদালত উপেক্ষা করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, মিন্নি রিফাতকে নয়ন বন্ডের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিল। মিন্নিই গুরুতর আহত অবস্থায় রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পত্রিকায় জানা যায়, মিন্নি রিফাত হত্যাকারীদের সাথে কয়েকবার আলোচনায় বসেছিল। সেই আলোচনা কি রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনার অংশ, নাকি অন্য কিছু?

রিফাত হত্যার পূর্বাপর অনেক ঘটনার সাথে পরাণ সিনেমার মিল নেই। যেমন, নয়ন বন্ড মারা গিয়েছিল বন্দুক যুদ্ধে।পুলিশ  নয়ন বন্ডকে নিয়ে বরগুনায় অভিযানকালে নয়ন বন্ডের সতীর্থদের সাথে পুলিশের গুলি বিনিময় হয়। সেখানে এনকাউন্টারে নয়ন বন্ড মারা যায়। পরাণ সিনেমাতে রোমানকে গুলি করে হত্যা করে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ।’পরাণ’ সিনেমায় অনন্যা আত্নহত্যার চেষ্টা করে কিন্তু বাস্তবে মিন্নির আত্নহত্যা চেষ্টার কোন খবর পাওয়া যায় না। পরাণ সিনেমায় এই রকম আরো অনেক আমিল রয়েছে বাস্তবের সাথে। তবে সবচেয়ে বেশি মিল খুজে পাওয়া যায় সিফাত হত্যার দৃশ্যে। এই মিলটি না থাকলে রিফাত হত্যার সাথে পরাণ সিনেমার কোন সম্পর্ক খুজে পাওয়া কঠিন হতো।

নির্মাতা রায়ান রাফি অস্বীকার করলেও দর্শকরা  রিফাত হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘পরাণ’ নির্মাণ করা হয়েছে বলেই গন্য করে। খবরে প্রকাশ, রিফাতের বাবা এবং মিন্নির বাবা দুজনই পরাণ সিনেমার বিরুদ্ধে মামলা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।

পরাণ সিনেমায় শরিফুল রাজ আর বিদ্যা সিনহা মীমের অভিনয় ছিল অধিকাংশ জায়গা জুড়ে। সিফাতের চরিত্রে ইয়াশ রোহানকে অনেক পরে আনা হয়েছে।

অনেক সিনেমাতেই দেখেছি, খলনায়ক অনেক সময় মূল চরিত্র হয়ে উঠে। পরাণ সিনেমাতেও তাই হয়েছে। কিন্তু বাস্তবের নয়ন বন্ডরা খলনয়কই থেকে যায়,মানুষের কাছে তারা নায়ক হয়ে উঠে না।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent