শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

ডোনাল্ড লু এবং রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশি শক্তির উপর ভরসা করে। কথাটি ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যখন বিরোধী দলে ছিল তারাও তখন বিদেশীদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেন-দরবার করেছিল।

- Advertisement -

এর একটি সাম্প্রতিক প্রমান পাওয়া যায় মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে।

ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের আগে বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয় তিনি নাকি পাকিস্তানে ইমরান খান সরকার এবং শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে সরকার পতনের মূল কারিগর বা মূল কুশিলব।

এই প্রচারণার কারনে বিরোধী শিবির এবং ক্ষমতাসীন শিবিরের মধ্যে ডোনাল্ড লুর আগমন উপলক্ষে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

বিরোধী শিবির ভেবেছিল, ডোনাল্ড লু এসে এমন কিছু বলবেন যাতে সরকার মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে। আবার সরকার পক্ষ থেকেও ভাবা হয়েছিল, তিনি বুঝি বাংলাদেশের উপর নতুন কোন নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছেন।

বলা বাহুল্য, বিরোধী শিবির এবং সরকারী শিবিরের এই সব speculation কোনটিই ঠিক হয়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগে র‍্যাবের উপর  বিচারবর্হিভূত  হত্যার কারনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর র‍্যাবের ক্রসফায়ার অনেকটাই কমে এসেছে।

ডোনাল্ড লু তার সফরে র‍্যাবের এই অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি আরও কিছু কথা বলেছেন যেগুলি কিছুটা রুটিন ওয়ার্কের মতোই শোনায়।

তিনি বলেছেন, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আমরা সব সময় কথা বলবো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের মিডিয়াগুলি ডোনাল্ড লু চলে যাওয়ার পর এই নিয়ে তাদের নানারকম স্পেকুলেটিভ বিচার-বিশ্লেষণ অব্যাহত রেখেছে। এর সংগে যুক্ত হয়েছে হাল আমলের নানারকম রাজনৈতিক বিশ্লেষক।বিশ্লেষকদের এই রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলি বেশির ভাগ দলিয় ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত। তাই এই বিশ্লেষণগুলিকে নির্মোহ বা নিরপেক্ষ বলা যায় না। আর যে সব বিশ্লেষণ দলিয় ভাবনা থেকে করা হয় তা কখনই নির্ভরযোগ্য হতে পারে না।

ডোনাল্ড লু ঝানু কূটনীতিক। তিনি যা বলবেন তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার এবং নিয়ম-নীতি মেনেই করবেন। তিনি এমন কিছুই বলবেন না যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।

আমি যতটুকু পত্র-পত্রিকায় এবং সোস্যাল মিডিয়াতে পড়েছি এবং শুনেছি তাতে মনে হয়েছে, ডোনাল্ড লু অত্যন্ত পেশাদারীত্বের সাথেই তার সফর সমাপ্ত করে ফিরে গিয়েছেন।তিনি একটি শব্দও তার কূটনৈতিক পেশাদারীত্বের সীমাকে লংঘন করে বলেননি।

তিনি কি কি বলেছেন, তাতে করে  কোন পক্ষের জন্য খুশির খবর আছে কিনা আর কোন পক্ষের জন্য দুঃখের খবর আছে কিনা তা খুবই অবান্তর ব্যাপার।

একজন কূটনীতিক নিশ্চয়ই তার ভিতরে কি চলছে তা কূটনৈতিক নিয়ম ভংগ করে বলতে যাবেন না। তিনি সরকারের চ্যানেলগুলিতে যে সব উপদেশ দেওয়ার সেইসব দিয়েছেন। এর কোনটাই হয়ত পাব্লিকলি বলার মতো না। তিনি ঠিক ততটুকুই পাব্লিকলি বলেছেন যতটুকু কূটনৈতিক সীমার মধ্যে বলা যায়।

সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়েও তিনি হয়ত সরকারের সাথে বিশদ আলোচনা করেছেন। কিন্তু এর খুব সামান্য পাব্লিকলি এসেছে। ডোনাল্ড লু দেখাতে চেয়েছেন,বাংলাদেশের কোন বিশেষ দলের প্রতি আমেরিকার কোন পক্ষপাতিত্ব নেই।

লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি বিদেশী প্রভুদের অনুকূল্যের উপর নির্ভর করে। সেটি বিদেশীরা ভালোভাবেই  জানে এবং উপভোগ করে।

কথা হচ্ছে, বিদেশী প্রভুরা আসলে কি কিছু  করতে পারে?

তারা নিশ্চয়ই রাতারাতি একটি দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে অন্য একটি দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে না।

তারা যেটি করতে পারে তা হচ্ছে, একটি দেশে সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেসব নিয়মক শক্তি থাকে সেই সব শক্তিগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।যেমন,সরকারের বিরুদ্ধে  বিরোধী দলগুলির আন্দোলনকে ভিতরে ভিতরে ইন্দন দিয়ে উস্কে দিতে পারে। প্রশাসনের ভিতর সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে উস্কে দিতে পারে।

এই সব কৌশল তারা অনেকটা নেপথ্যেই করে এবং অনেক সময় সফলও হয়।

কিন্তু কোন রকম মাধ্যম ছাড়া তারা একটি দেশের সরকারকে উৎখাত করতে পারে তা একবারেই  কাঁচা মাথার  অনুর্বর চিন্তা। অন্তত এই যুগে এমনটি সম্ভব নয়।

আর আমেরিকা বিভিন্ন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় নানা কারনে। এই নানা কারনের মধ্যে কোন দেশকে তাদের নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা  একটি অন্যতম কারন। এই নিষেধাজ্ঞাগুলিকে  একধরনের বার্গেনিং ফ্যাক্টর বলা যায়। বার্গেনিং করে তারা কার্যোদ্ধার হলে এই সব নিষেধাজ্ঞা আবার তুলেও নেয়। এইসব নিষেধাজ্ঞা থেকে কোন দলের ভাবা উচিত নয় কিংবা মহা আনন্দিত হবার কিছু নেই যে, আমেরিকা তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে এবং ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবে।

কার্যোদ্ধার যেখানে মূখ্য, সেখানে কার্যোদ্ধার হয়ে গেলেই তারা খুশি। এই কার্যোদ্ধার ক্ষমতাসীনদের মাধ্যমেও হতে পারে।

বেশী চাপাচাপি করলে আবার আমেরিকার বিপরীত বলয়ের দিকে খুব বেশি ঝুকে পড়তে পারে,এই বিষয়টিও  তাদের মাথায় কাজ করে। তাই নরম-গরম থেরাপির মাধ্যমে অনেক সময় তারা কার্যোদ্ধার করতে চায়।

ডোনাল্ড লুর এই সফরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের কোন বিরোধী দলের কারো সাথে সাক্ষাৎ করেননি। সাধারণত কূটনীতিকরা একটি দেশ সফরে গেলে তারা বিরোধী দলের সাথেও সাক্ষাৎ করেন কিন্তু ডোনাল্ড লু তা করেননি।

এমনও তো হতে পারে, তিনি সরকারকে বার্তা দিতে চাচ্ছেন, তোমরা আমাদের সম্পর্কে যে রকম ভাবছো আসলে সেইরকম কিছুই নয়। আবার বিরোধী দলকেও হয়ত তিনি বার্তা দিতে চাচ্ছেন, তোমরা যেরকম ভাবছো আসলে সেইরকম ভাবার কোন কারন নেই।

কূটনীতিকরা অনেক সময় indirect way তে বার্তা পৌঁছে দিতে চায়।

সেই বার্তাগুলি decode করতে পারাই আসল।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent