শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

গণতন্ত্রের বুলি এবং হিপোক্রেসি

কানাডাতে তিন স্তরের সরকার আছে ফেডারেল প্রভিন্সিয়াল আর মিউনিসিপ্যাল এই তিন স্তরের সরকারই জনগনের দ্বারা নির্বাচিত সরকার

জীবনে অনেক মানুষকে দেখেছি, কথায় কথায় গনতন্ত্রের বুলি কপচান। কিন্তু বাস্তবে মনে-প্রানে এদের অনেকেই স্বৈরাচারী মনোভাবের অধিকারী।

গনতন্ত্রের জন্য যে কথা বলে তাকে অবশ্যই গনতন্ত্রকে মনে-প্রানে ধারন করতে হয়। শুধু কথায় নয়, কাজে-কর্মে, আচরণে গনতান্ত্রিক হতে হয়।

- Advertisement -

গনতন্ত্রের জন্য কথা বলবেন অথচ ভিন্নমত নিতে পারেন না,গনতন্ত্রের জন্য কথা বলবেন অথচ কেউ আপনার থেকে ভিন্ন আদর্শ, ভিন্ন মতবাদ, ভিন্ন নীতি ধারন করলে তাকে আপনি সহ্য করতে পারেন না, তাহলে আপনি কেমন গনতন্ত্রী ?

মুখে গনতন্ত্রের কথা বলা আর মনে-প্রানে গনতন্ত্রের চর্চা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। যা বলবেন তা মনে-প্রানে বিশ্বাস করতে হবে এবং মনে-প্রানে ধারন করতে হবে।

আমার নিজের ব্যাপারে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, আমি গনতন্ত্রের খুব একটা  big fan নই। আমি মনে করি না গনতন্ত্র সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা। হতে পারে এটি অনেকের কাছে সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা।

তবে নিজের মধ্যে গনতন্ত্র চর্চার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টায় অনেক সময় বিফল হই। কেউ ভালো যুক্তি দিলে আমার থেকে ভিন্নমত হওয়া স্বত্তেও তা শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করি। ভালো যুক্তি, ভালো আর্গুমেন্টকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কেউ আর্গু  করতে গিয়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ,খোঁচা, ব্যক্তিগত আক্রমণ কিংবা আমার জ্ঞান/শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে আমি রিএক্ট করি।আমি এটাও বুঝতে সক্ষম যেঅনেক সময় আমার রিএক্ট করাটা গনতন্ত্রসুলভ  হয় না। কিন্তু কিছু করার নেই। গনতন্ত্র একটি সিস্টেম  আর মানুষের মন অনেক সময় সেই ছঁকেবাঁধা সিস্টেম মেনে চলে না। মানুষের মন জটিল এবং বিচিত্র। তবে চর্চার মাধ্যমে একে উত্তরোত্তোর উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। মন এবং মননের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে পরমতসহনশীলতা অর্জন করা সম্ভব। সেটি একদিনের নয়, নিরন্তর প্রচেষ্টার ফল।

আমি মনে করি,গনতন্ত্র একটি সংখ্যার খেলা। এর সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে, যে দল মেজরিটি পায় সেই দল ইচ্ছে করলে সব মতামতকে উপেক্ষা করে স্বৈরাচারের মতো আচরন করতে পারে।সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া সরকারের ইচ্ছার উপর সব কিছু নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া দল গনতান্ত্রিক আচরণ না করে স্বৈরাচারের মতো আচরন করে। এটি অবশ্যই গনতন্ত্রের দুর্বল দিক।

আবার যে সরকার মেজরিটি পায় না সেই সরকারকে সংখ্যালঘুর সরকার হিসাবে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।সংখ্যালঘু সরকার বেশিদিন টেকসই নয় বলে ঘন ঘন ব্যয়বহুল নির্বাচন করে জনমত নিতে হয়। কানাডার গত সংখ্যালঘু  লিবারেল সরকার ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়  নির্বাচন করেছিল কিন্তু সেই সরকার আবারও সংখ্যালঘু সরকারই উপহার দিয়েছে। এটিও গনতন্ত্রের দুর্বলতা।

অনেক দেশেই কিছুদিন পর পর নির্বাচন হয় শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সরকারের কারনে।

গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বিলম্ব হয়। পার্লামেন্টে পাস হওয়া, আইনে পরিনত হওয়া, এরপর বাস্তবায়ন হওয়া; মোটামুটি দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া। আবার সংখ্যালঘুর সরকার হলে বিল পাস করার ক্ষেত্রে অন্য দলের ভোট বা সমর্থনের উপর নির্ভর করতে হয়।

অনেক দেশে গনতন্ত্রকে কিভাবে আরো বেশি শক্তিশালী করা যায় সেই ব্যবস্থা আছে। অনেক দেশে প্রধানমন্ত্রী আর প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি থাকে। যাতে চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকে। অনেক দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট এবং হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা অন্যান্য দেশ থেকে ভিন্নতা পেয়েছে তার ইলেক্ট্ররাল কলেজ সিস্টেমের কারনে। এখানে প্রপুলার ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট হতে হলে ইলেক্ট্ররাল কলেজ ভোটে জয়ী হতে হয়। প্রপুলার ভোট বেশি পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন না, কারন,ইলেক্ট্ররাল ভোটে জয়ী হননি।

ভারতে লোকসভা, বিধান সভার ব্যবস্থা আছে। কয়েকটি দেশে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনে ৫০% ভোট পেতে হয়। ৫০% ভোট না পেলে আবার নির্বাচন হয়। অনেক দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আছে। স্থানীয় পর্যায়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব থাকে।

কানাডাতে তিন স্তরের সরকার আছে। ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল আর মিউনিসিপ্যাল। এই তিন স্তরের সরকারই জনগনের দ্বারা নির্বাচিত সরকার।

তাই দেখা যায়, গনতন্ত্রকে জনগনের সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সিস্টেম চালু আছে।

এরপরেও আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, গনতন্ত্রের সবচেয়ে সবল এবং শক্তিশালী দিক কি?  এর উত্তরে আমি বলবো, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর জনগন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকারের পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এটিই গনতন্ত্রের অন্যতম শক্তিশালী দিক। গনতন্ত্রের  অর্থ জনগন ক্ষমতার মালিক।

প্রশ্নটা সেখানেই, যে জনগন ক্ষমতার মালিক সেই জনগন কেমন জনগন, তাদের কোয়ালিটি কি

গনতন্ত্রের অনেক কিছুই নির্ভর করে সুশিক্ষিত, সুসভ্য জনগনের উপর। কারন, একমাত্র সুশিক্ষিত, সুসভ্য জনগনই পারে সঠিকভাবে  choose করতে।

আর পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যে সব দেশে গনতন্ত্রের ছিটেফোঁটা নেই কিন্তু কোন দিক দিয়ে তারা পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না।

পৃথিবীর অনেক স্বৈরশাসক তাদের দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। আধুনিক তুরষ্কের জনক কামাল আতাতুর্ক গনতন্ত্রের কোন তোয়াক্কা  করেননি। তিনি দেশকে শুধু উন্নয়নের দিকেই নিয়ে যাননি, তিনি দেশকে প্রগতিশীলতার পথেও এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

কমিউনিস্ট চীনের অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। দেশটি এখন পরাশক্তিগুলির সাথে টেক্কা দিয়ে চলে।

কমিউনিষ্ট দেশ কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বে চিকিৎসা সেবার মধ্যে অন্যতম। কিউবার স্বাস্থ্য সেবা মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতো বটে, বহু ধনী দেশের স্বাস্থ্য সেবাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

স্বাস্থ্যখাতে মাথাপ্রতি মোটে ৪৩১ মার্কিন ডলার খরচ করে কিউবার শিশুমৃত্যুর হার এখন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে কম, গড় আয়ু যুক্তরাষ্ট্রের সমান। অথচ যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্যখাতে মাথাপ্রতি খরচ করে সাড়ে আট হাজার ডলারের বেশী।ভাবুনতো দেখি, ডাক্তার এসে আপনার দরজায় কড়া নাড়ছে। সে বাড়িতে এসেই আপনার পুরো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। শুধু আপনারই নয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে আপনার পরিবারের সবার। এই হচ্ছে সংক্ষেপে কিউবার চিকিৎসা সেবার বিবরন।

ভিয়েতনাম একটি কমিউনিষ্ট দেশ।  ১৯৯০-এর দশকে ভিয়েতনামের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭% হারে বৃদ্ধি পায়। অব্যাহত প্রবৃদ্ধির ফলে ২০০৮ সাল নাগাদ ভিয়েতনামের স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দাঁড়ায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ৩৫০০ ডলারের মত। সেবাখাত (৩৮%) ও শিল্পখাত (৪২%) প্রধান দুই অর্থনৈতিক খাত। তবে দেশের প্রায় ৫৭% শ্রমিক এখনও কৃষিজীবী।

এই রকম আরো অনেক দেশের উদাহরণ দেওয়া যায়, যে সব দেশ গনতন্ত্র ছাড়াই অনেক উন্নত,শিক্ষিত,সুসভ্য।

একটি দেশকে মজবুত এবং টেকসই অর্থনীতির উপর দাঁড় করানোর পর গনতন্ত্র অনেক বেশি ফলপ্রসূ।

যে কোন তন্ত্রই ভালো যদি তা সঠিক এবং সদিচ্ছার সাথে প্রয়োগ করা হয়। আর সদিচ্ছা না থাকলে যত ভালো তন্ত্রই হোক না কেন তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

উপরের দীর্ঘ লেখাটি কোন কিছুকে জায়েজ করার জন্য নয় বরং বেশ কিছু ভাবনা দ্বারা তাড়িত হয়ে লেখে ফেললাম।

পরিশেষে বলবো, দল এবং রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে গনতন্ত্রের কথা যারা বলেন তাদের নিজেদের ব্যক্তি পর্যয়েও গনতান্ত্রিক হওয়া জরুরী। মুখে গনতন্ত্রের বুলি আর অন্তকরণে হিটলারী মনোভাব, সেটা আর যাই হোক গনতন্ত্র নয়, হিপোক্রেসি।

 

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent