বৃহস্পতিবার - মার্চ ২৮ - ২০২৪

শেলাচাপড়ীর চোরাবালি : তৃতীয় পর্ব

ছবিমোহাম্মদ নোহাসি

সকালের মেঘ সরে গেছে। রোদ ক্রমশ ঝাঁঝালো হয়ে উঠছে। নৌকা থেকে নেমে চার সদস্যের পুলিশ দল ক্ষেতের আইল বেয়ে চলছে। মানুষজন নেই। হাতেম মোল্লার বাড়ি দেখিয়ে দেবার মতো কাউকে পাওয়া গেলোনা। নৌকার মাঝি পাশের গ্রাম নুনদহ থাকে। হাতেম মোল্লার বাড়ি শেলাচাপড়ীর উত্তরপাড়ায়, এটুকু পর্যন্তই তার জানা। পাড়ার মধ্যভাগে এক গড়ান বেয়ে উঠে যায় মাঝি। গ্রামের বাড়ীগুলো ধানক্ষেতের সমভূমি থেকে বেশ উঁচু। বন্যায় যাতে তলিয়ে না যায় সেকারণে এব্যবস্থা। ধানক্ষেত থেকে স্লোপ বেয়ে উপরে ওঠার রাস্তাকে এঁরা গড়ান বলে। গড়ান বেয়ে উঠতেই এক কুঁড়েঘর। ছোট একটি ছেলে পুলিশ দেখে দৌড়ে পালায়। কাঁখে কলস নিয়ে শীর্ণ মহিলা যাচ্ছিলো নদী ঘাটে। তাঁকে আটকে ধরে মাঝি। ভড়কে গিয়ে পালাবার চেষ্ট করে মহিলা। মাঝি হাক দেয়। খাড়াও। হাতেম মোল্লার বাড়ি কোনডা?

দুই হাত ঘোমটা টেনে মহিলা উত্তর দেয়, পূবে ছয় বাড়ি বাদে।

- Advertisement -

বাড়িত কেডা কেডা আছে।

আমি জানিনা।

মহিলা কাঁপতে থাকে। সোহেল থামতে বলে মাঝিকে।

ওকে যেতে দাও মাঝি। পূর্বদিকে ছয় বাড়ি পরে আমরা হাতেম মোল্লার বাড়ি পেয়ে যাবো।

বিশাল বাড়ি। চারটে বড় বড় টিনের ঘর। চকচকে ঢেউ টিন। শান দেয়া মেঝে। দেখে মনে হয় সদ্য ধনী হওয়া গ্রাম্যজন।

পুলিশ আসার খবর বোধহয় সবাই পেয়েছে। বাড়ি শুনশান। বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে মাঝি উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে। বাড়িত কেউ আছে? পুলিশ আইছে।

সাড়াশব্দ নেই। ভেতরের উঠোনে ঢোকে ওঁরা পাঁচজন। হাবিলদার লিয়াকত সামনে। ইচ্ছে করেই জোরে জোরে বুট ফেলে। ওর পেছনে বাকিরা। অনেকটা পিছিয়ে থেকে ধীর পায়ে হেঁটে আসে ইন্সপেক্টর সোহেল।

ভেতর উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাই। লিয়াকত চিৎকার দেয়। কেউ নাই আপনেরা? কোনো মহিলা? কেউই নাই?

তবু সাড়া নেই। হঠাৎ শিশু কান্না শোনা যায়। সাথে ক্ষীণ স্বরে মহিলা কন্ঠ। গলায় কৃত্রিম চাপ দিয়ে বলছে, চুপ হ। বাড়িত পুলিশ আইছে। চুপ কর।

সোহেল নিশ্চিত হয়। ভেতরে মানুষ আছে। উচ্চস্বরে ভদ্রকন্ঠে বলে, আপনাদের ভয় নেই। কেউ একজন বাইরে আসুন। আমরা কথা বলে চলে যাবো।

খানিকবাদে একজন মধ্যবয়ষ্ক ভদ্র মহিলা বেরিয়ে আসেন। মাথায় ঘোমটা। মুখ পুরোপুরি খোলা। হাতের বেশিরভাগ ঢাকা হলেও রং লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ভীষণ ফর্সা। হলুদাভ ফর্সা গায়ের রং।

বাইরে আসার পর সোহেলই প্রথম সালাম দেয়। লিয়াকত আর সুবীর একটু অবাক হয়। চাকরী জীবনে ওরা বোধহয় গ্রামের মহিলাকে পুলিশের সালাম দেয়া দেখেনি।

ওয়ালেকুম আসসালাম। বেশ লম্বা করেই সালামের উত্তর দেন মহিলা।

সোহেল সামান্য এগিয়ে আসে। দুপাশে তাকায়। কেউ নেই। কেবল একটি নেড়ী কুকুরকে লেজ নাড়িয়ে পালতে দেখে। ঘাড় ফিরিয়ে সোজা মহিলার দিকে তাকান। হাতেম মোল্লা আপনার কি হন?

আমার শশুর।

আপনি কি এ বাড়িতেই থাকেন?

না, আমি ঢাকায় থাকি।

আপনার স্বামী কোথায়?

ঢাকাতেই আছেন।

আপনার শশুর কি বাড়িতে আছেন?

উনি ঢাকা গেছেন।

বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই?

এ মুহূর্তে নেই।

কেনো?

আপনাদের ভয়ে। দেশে এমনিতেই সামরিক শাসন চলছে। তার উপর গ্রামে খুনখারাবি।

এ খুনের ব্যাপারে আপনি কিছু শুনেছেন?

না, আমি কিছুই জানিনা।

প্রায় মাস খানেক আগের ঘটনা। কারো কাছে কিছু শোনেননি?

না, শুনিনি। আমি বাড়ি এসেছি সপ্তাহ খানেক। এখানে এসে এসব ব্যাপার জেনেছি।

গহর মিস্ত্রীর পরিবারের কাউকে চেনেন?

মহিলা একটু দ্বিধায় পড়লেন। আঁচল টানার ভান করে বেশ সময় নিলেন। চোখের মনিদুটো আকাশে ঘুরিয়ে এনে সোজা ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালেন। কড়াভাবে উত্তর দিলেন, চিনিনা।

ওঁদের বাড়িটা কোনদিকে জানাবেন।

মাফ করবেন।  আমি এ গ্রামের মেয়ে নই। শশুর বাড়ি আর তাঁদের দু’একজন জ্ঞাতি ছাড়া কারো বাড়ি চিনিনা।

বাড়ি এসেছিলেন কেনো?

আমার শাশুড়ি অসুস্থ। তাঁকে সেবা দিতে।

কতদিন থাকবেন?

শশুর এবং ছোট ননদ এলেই আমি চলে যাবো।

ছোট ননদ কি ঢাকা থাকেন?

জ্বী।

আপনাকে আসলে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। আপনার শশুর এলে থানায় যোগাযোগ করতে বলবেন। অপরাধ না করলে পুলিশকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

আপনারা প্রমান ছাড়াই মানুষকে ধরে নিয়ে যান। এখানেই সাধারণ মানুষের ভয়।

সোহেল মৃদু হাসে। পুলিশের মুখে এ হাসি মানায় না। মাথা নেড়ে জবাব দেয়। ‘আপনি বেশ জানেন দেখছি।’

ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent