বৃহস্পতিবার - মার্চ ২৮ - ২০২৪

ঝালস

ছবিমার্কুজ স্পাইসকে

প্রথম পর্ব:

বুঁদবুঁদ একটুও কমছে না। আর্ক ওয়েল্ডিংএর গনগনে আগুনে লাল হয়ে খুলে পড়েছে লোহার প্লেট। মাটির পঞ্চাশ ফুট গভীরে জমে থাকা দুই ইঞ্চি জলের উপর। আকাশের তারা খসার মতো টুপ করে পড়লো। তপ্ত লোহার স্পর্শে টগবগিয়ে ফুটছে জল। তিনজনের আধা ডজন দৃষ্টি স্থির এক জায়গায়। জল না আগুন! কোনটির শক্তি বেশী?

- Advertisement -

পঞ্চাশ ফুট গভীর গোলাকার শ্যাফটের মুখটা বেশ সরুই। জ্যামিতিক ব্যাসার্ধ মাত্র পাঁচ ফুট! পুরো স্ট্রাকচারের আদল জমিদার বাড়ির কুয়ো বা ইঁদারার মতো। ইঁদারার তলায় জরুরী টানেল সংযোগের কাজ করছে জোসেফ, ক্রিস আর ইয়ান।

বুঁদবুঁদ থেমে গেছে। ইয়ান আঙুল ডুবিয়ে ছ’ ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি প্লেট তুলে আনে। নতুন স্পেসার লাগাতে হবে পাইপের মুখে। তানাহলে হাইড্রোলিক জ্যাক দিয়ে পাইপ মাটির ভেতর ঢোকানো যাবেনা।

বুকে সামান্য চিন চিনে ব্যাথা ক্রিসের। আলতো করে বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে জোরে শ্বাস নিলো। জোসেফ পিঠে হাত রেখে বলে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

না না সেরকম কিছু নয়।

তাহলে দূর্বল লাগছে?

না, তাও নয়।

শাপের মতো প্যাঁচানো এক ফুট ব্যাসের ফেব্রিক পাইপে উপর থেকে ক্রমাগত ফ্রেস বাতাস পাঠানো হচ্ছে। ইয়ান তবু অক্সিমিটার চেক করে। শ্যাফটের তলায় অক্সিজেন পর্যাপ্ত আছে কিনা। ডিজিটাল রিডিং দেখলো ১৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। মন্দ নয়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সাড়ে ১৯ থেকে ২৩ শতাংশ অক্সিজেন প্রয়োজন পড়ে। তবে ওয়েল্ডিং চলাকালে বাতাসে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন অগ্নিকান্ড ঘটাতে পারে।

নতুন ওয়েল্ডিং শুরুর আগে ক্রিসকে উপরে পাঠাতে চায় জোসেফ। পরিবর্তে অন্য কেউ এসে ওয়েল্ডিং করুক। মাথা পেছনে হেলে কপালটাকে আকাশের দিক উঁচু করে জোসেফ হাক দেয়। প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে পৌঁছায় উপরে দাঁড়ানো ‘টপম্যান’ সানির কানে।

সানাউল্লাহ মিয়া আজ টপম্যানের দায়িত্ত্বে আছে। কুয়োর ভেতর নামেনি। হেলথ এন্ড সেফটি রুল অনুযায়ী কুয়োর তলায় কেউ কাজ করলে উপরে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চার সদস্যের ক্রু। সানাউল্লাহ টিম লীড। দায়িত্ত্ব বন্টনের কাজটা ওকেই করতে হয়। এগারো বছর হলো কোম্পানীতে আছে। আগামী বছর যুগপূর্তি!

জোসেফ চিৎকার করে বলে, “সানি, নিচে নেমে আসতে পারো। ক্রিস একটু অসুস্থ বোধ করছে।”

“ওকে উঠে আসতে বলো জো।” খেরখেরে ইংরেজি উচ্চারণে সানাউল্লাহ জবাব দেয়। জোসেফকে ওরা জো বলেই ডাকে। সানাউল্লাহকে যেমন সানি।

ক্রিস উঠে আসে। পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠার কোনো এলিভেটর নেই। সিঁড়ি নেই। কুয়োর মতো গর্তে উঠানামার সিঁড়ি বসাবার জায়গা থাকেনা। কুয়োর গা ঘেঁসে কংক্রীটের ওয়ালে ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির লোহার পাতের সাথে রড ঝালাই করে মই বানানো আছে। মইটি আবার অর্ধাকার বৃত্তচাপ আকৃতির টিন দিয়ে মোড়ানো। নিরাপত্তার জন্য এই টিনের বেষ্টনী ।

ক্রিসের বুকের ছাতি হাপরের মতো ফুলে উঠছে। আবার শ্বাস ছাড়ায় নীচে নামছে।

‘এতো হাঁপাচ্ছো কেনো ক্রিস? কংক্রীট ব্লকে বসে একটু জিড়িয়ে নাও।’ এ্যাংকর বোল্ট লাগানো বিশাল আকৃতির কংক্রীট ব্লকটা দেখিয়ে দেয় সানাউল্লাহ।

ক্রিস শরীর থেকে হার্নেস খুলে ফেলে। হার্নেস হলো একধরণের সেফটি বেল্ট। গাড়ির সেফটি বেল্টের তুলনায় অনেকগুণ বেশী শক্ত। হার্নেসের একটি গিটের সঙ্গে ইস্পাতের রিং বাঁধা থাকে। রিং বাঁধা গিটটি পিঠের কেন্দ্র থেকে একটু উপরের দিকে রাখা হয়। কুয়োর তলদেশে জ্ঞান হারালে এই রিং ধরে ক্রেন দিয়ে তাঁকে টেনে তোলা হয়।

আবার উঁচু জায়গা থেকে পতন রোধের জন্য হার্নেসের রিংএ ল্যানিয়ার্ড লাগানো হয়। ল্যানিয়ার্ডের অপর প্রান্ত নোঙর করা হয় বিশালাকৃতির কংক্রীট ব্লকের সাথে। উপর থেকে যাতে কেউ পড়ে না যায়।

কংক্রীট ব্লকের এক পাশে হার্নেস রেখে সমতল জায়গায় বসে পড়ে ক্রিস। কুলিং বক্স থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল বের করে সানাউল্লাহ। এগিয়ে দেয় ক্রিসের দিকে।

‘ধন্যবাদ সানি।’

‘পরের দুই ঘন্টা তুমি উপরে দাঁড়িয়ে টপম্যানের কাজ করো। ওয়েল্ডিং করতে আমি নীচে যাচ্ছি। লাঞ্চের আগে উঠবো।’

ঝটপট ল্যানিয়ার্ড খুলে ফেলে সানি। এতোক্ষণ উপরে দাঁড়িয়ে নীচে দেখছিলো। পতনরোধে হার্নেসে ল্যানিয়ার্ড রাখতে হয়েছে। এখন প্রয়োজন নাই। শুধু হার্নেস বেঁধে লোহার মই বেয়ে নামতে শুরু করে।

খাড়া মই। প্রতি দশফুটে ফুটো করা ঝালরের মতো লোহার পাটাতন। সানাউল্লাহ না থেমে সপাসপ নেমে যায়। তিরিশ ফুট নামার পর মাথাটা ঝিমঝিম করে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে। চোখ ডলার চেষ্টা করে। হাতে গ্লোভস। চোখে সেফটি গ্লাস। গ্লোভস খুলে সেফটি গ্লাসের ভেতর আঙুল ঢুকায়। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে দুচোখে একত্রে ডলা দেয়।

উপরের তুলনায় নীচে আলো কম। চোখ খুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে সানাউল্লাহ। ইয়ান আর জো ছপছপে পানিতে দাঁড়িয়ে। দুইঞ্চি পানি। কিন্তু তাতেই তিরতিরে স্রোত। কুয়োর তলা থেকে উত্তর দিকে যে আনুভূমিক টানেল কাটা হচ্ছে এ পানি সেখান থেকেই আসছে।

মিউনিসিপ্যাল শ্যাফটের ওয়াল কেটে ভেতরে খুঁড়ে একটু একটু করে বানানো হচ্ছে টানেল। টানেলের ভেতর হাইড্রোলিক জ্যাক দিয়ে বিশাল ব্যাসের লোহার পাইপ প্রবেশ করানো হয়েছে। এক মানুষ উঁচুসম পাইপ। পাইপের ভেতর মাটি কেটে সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর হাইড্রোলিক চাপে আরেকটু ভেতরে পাইপ ঢুকানো হয়। এমনি করে ক্রমশ এগিয়ে নেয়া হয় টানেলের খনন কাজ।

ছোট ছোট দৈর্ঘ্যের পাইপ। ব্যাসের তুলনায় দৈর্ঘ্য  অনেক কম। মাত্র তিনফুট। তিনফুট প্রবেশ করানোর পরই নতুন পাইপ জোড়া দেয়া হয়। সুচারু ওয়েল্ডিংএ সারতে হয় এই জোড়ার কাজ। বাংলাদেশী ওয়েল্ডিং মাস্টার সানাউল্লাহ মিয়া এই চারু কাজের কারিগর।

তিরিশ ফুটের তিন নম্বর পাটাতনে সানাউল্লাহ দাঁড়িয়ে। এবার উপরে তাকায়। কেউ নেই। ক্রিসের আসার কথা। বেচারা বোধহয় এখনো বিশ্রামে। থাকুক কিছুক্ষণ। পুরোনো সম্পর্ক ব্রেকআপের পর নতুন গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছে মাত্র। শরীরে এখন তাগদ দরকার!

ঝিমুনি ভাবটা কাটেনি। তবু নীচে নামা শুরু করে সানি। মাত্র বিশ ফুট। ইয়ান আর জো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। চোখ দুটো আবার চুলকাচ্ছে। কিন্তু চুলকানোর উপায় নেই। দুই হাত ব্যস্ত মইয়ের পাদানি রডের উপর। ওটা পা রাখার জায়গা, আবার ওটাই হাত রাখার আশ্রয়। পায়ে লম্বা চোঙাওয়ালা সেফটি বুট। জলকাঁদায় কাজ করতে চোঙাওয়ালা বুটের বিকল্প নেই। কিন্তু মই বেয়ে ওঠানামায় বড়ই অস্বস্তিকর।

চতুর্থ বা শেষ পাটাতনে পৌঁছে যায় সানি। চতুর্থ পাটাতন থেকে নীচে নামতে খোলা মই লাগানো। চতুর্পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নাই। কারণ মাত্র দশ ফুট দূরত্বে কুয়োর তলদেশ।

টানেল থেকে আসা পানির পরিমান বেড়েছে। ওয়েল্ডিং কাজ চলায় এ মুহূর্তে ডিওয়াটারিং বন্ধ। পাম্প চলছেনা। থিকথিকে পানি। নীল আকাশের প্রতিবিম্ব দেখা যায়না। তবে সূর্যের আলো প্রতিবিম্বিত হয়ে আসছে। জলাক্রান্ত পুরো জায়গাটি সাদা দেখাচ্ছে। পাটাতনে দাঁড়িয়ে সানির মাথাটা এবার চক্কর দিয়ে ওঠে।

পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরোনো স্মৃতি ভেসে ওঠে। করতোয়ায় বাঁশের খরা দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য। তিনটি লম্বা বাঁশে ত্রিভুজাকার স্ট্রাকচার। ত্রিভুজের একটি কোণা শক্ত করে বাঁধা আরেকটি উল্লম্ব দীর্ঘাকার বাঁশে। ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল এলাকায় জাল বাঁধা। স্রোতের দিকে মুখ রেখে পাতা হয়েছে। যাতে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে মাছ এসে ধরা দেয় জালে।

ছেলেবেলায় এই বাঁশ বেয়ে সানাউল্লাহ অসংখ্যবার উঠেছে। উল্লম্ব বাঁশের মাথায় উঠে জলের দিকে তাকাতো। সূর্যের চিকচিকে আলোয় পানির কিছু অংশ সিলভারের মতো ঝকঝকে সাদা দেখাতো। জো আর ইয়ানের পায়ের তলায় স্বল্প জল। তবু সেরকম সাদাই লাগছে।

শ্যাফটের উপরটা পুরো ফাঁকা। দশ ফুট ব্যাসের মুখ এবং আশপাশ যথাসম্ভব খালি রাখা হয়েছে। তলায় প্রকৃতির আলো বাতাসের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। এরিমাঝে সূর্য এসে দাঁড়িয়েছে কুয়োর খাড়া উপরে। আয়নায় প্রতিসরিত হয়ে সূর্যালোক যেমন চোখ ধাঁধায়, কুয়োতলের পানিতে ঠিক সেই চমক। সানাউল্লাহ ফিরে যায় শৈশবের দিনে।

নীচে জো কিংবা ইয়ান নেই। শরীর জলে ডুবিয়ে শুশুকের মতো উঁচু হয়ে আতু আর কালু জলে ভাসছে। আতাহার আলী গাঁয়ের লোকের আদরে আতু হয়েছে কখন সে নিজেও জানেনা। কুঁচবরণ আবুল কালাম ‘কালু’ হয়েছে ওর গাত্র রঙে।

চকচকে দাঁতে কালু খিলখিলিয়ে আসে।

এ সানা, চায়া দেহোস কি? বাঁশেত থা লাফ দে।

পাশে আতু এক হাতে সাঁতারের জল ঠেকায়। আরেক হাতে সানাউল্লাহকে ডাকে।

‘এ সানা দেরী করোস ক্যা? লাফ দে।’

হ্যালুসিনেশন। সানাউল্লাহ নিশ্চিত ওর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। সবই ভুল দেখছে! কিন্তু আতু আবার ডাকে,

‘বুজছি, আইজক্যা বাত খাস নাই। তোর দাদী তোক খাইবার দেয় লাই।’

শ্যাফটের তলা থেকে হঠাৎ গগণবিদারী চিৎকার। হেল্প! হেল্প! হেল্প।

সানাউল্লাহর আর কিছু মনে নেই।।

ব্রামটন, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent