বৃহস্পতিবার - মার্চ ২৮ - ২০২৪

হোম সিকনেস

জার্মানের ফ্রাংকফ্রুট যাচ্ছি ইউরোপিয়ান আর্ক নামে একটি সংস্থার এওয়ার্ড  অনুস্টান কাভারে। গালফ এয়ারে জার্মান যাবার পথে কি ভোগান্তিতে পড়েছিলাম সেই স্মৃতিটা এখনো মনে আছে। একই সাথে চিরশত্রু পাকিস্তানিদের উপর রাগটা আরো বেড়েছিল সারজাহ এয়ারপোর্টে।

- Advertisement -

ঢাকা থেকে সন্ধ্যা সাতটায় আমার ফ্লাইট। চারঘন্টায় বাহারাইন পৌঁছে যাই কোন ঝামেলা ছাড়াই। সারজাহায় আমার একঘন্টার বিরতি শেষে কানেক্টিং ফ্লাইট বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়। সারজাহ এয়ারপোর্ট অনেক আধুনিক ও খুবই সুন্দর। আমি ট্রানজিটের এই একঘন্টা সময় কফিপান , ঘুরে ফিরে এবং ইমিগ্রেশন শেষ করে কাটিয়ে দেই।

ট্রানজিট এয়ারপোর্টে নেমে আমি সব সময় প্রথমেই লোকাল টাইম এডজাস্ট করি। তারপর বোর্ডে খুঁজে নেই আমার পরবর্তী ফ্লাইট নাম্বার, ডিপারচার টাইম এবং গেইট নাম্বার । পেয়ে গেলে শান্তিমতন একটা কফি খেয়ে স্মোকিং জোন খুঁজে বের করি। আরাম করে সিগারেট টানার তৃপ্তিই আলাদা।

স্মোকিংজোন হতে বের হবার পর সময় দেখি। প্লেন ছাড়ার মাত্র ২০/২৫ মিনিট বাকি। ৬/ এ গেইটের সামনে  ফ্রাংকফ্রুটগামী গালফ এয়ারের বিশাল লাইন। সবাই বোর্ডিংকার্ড ও ল্যাগেজ ট্যাগেজ নিয়ে এগুচ্ছে। আমিও আমার হ্যান্ডল্যাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। আমার পিছনে তখন ৭০/৮০ জন সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছুক্ষন অপেক্ষার পর বোর্ডিংকার্ড দেখিয়ে সিকিউরিটি চ্যানেল অতিক্রম শেষে প্লেনে উঠার টার্মাকে যেতেই এক সিকিউরিটি অফিসার আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। বুকপকেট হতে পাসপোর্ট হাতে দিতেই তিনি আমাকে হল্ট করালেন এবং সাইডে দাঁড় করিয়ে আমার পিছনের যাত্রীদের হাসিমুখে সি অফ করছেন গুড ইভেনিং স্যার, হ্যাভ এ নাইস জার্নি ম্যাডাম সম্ভাষনে। কিন্তু আমাকে কেন দাঁড় করিয়েছে আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মতন আদেশ শিরোধার্য করে দাঁড়িয়ে থাকি।

বার কয়েক জিগেস করি, কি সমস্যা। সে কোন উত্তর না দেয়ায় বিরক্ত লাগে।  আচরনে মনে হচ্ছিল, আমি বাংলাদেশী হয়ে জার্মান কেন যাবো? আমি কেন মিডিল ইস্টের প্যাসেঞ্জার হলাম না?

টার্মাক প্যাসেজের এক সাইডে দাঁড়িয়ে রীতিমতন ঘামছি। আমার পাসপোর্ট তখনো ছয় ফুট লম্বা চাপদাঁড়িওলা পাকিস্তানি সিকিউরিটি অফিসারের হাতে। বিপদে পড়েছি কিনা বুঝতে পারছি না। এরকম সময় আমার গলা দিয়ে কথা বের হয় না। গলা শুকিয়ে ঘন ঘন পানির পিপাসা পায়, আতংকে প্রেশার লো হয়ে যায়।

ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে আবারও জিগেস করি, হোয়াট হ্যাপেন্ড? এনিথিং রং? ক্যান আই নো, হোয়াই ডিড ইউ হল্ট মি?

সেই পাকিস্তানি আমার কথায় কান দেয় না। সে অন্য যাত্রীদের সাথে গুড ইভেনিং স্যার বা ম্যাডাম বলতে ব্যস্ত। আমি ১৫/২০ মিনিট অসহায়ের মতন দাঁড়িয় থাকতে থাকতে চরম বিরক্ত। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি খ্যাতাপুরি বিদেশের। জার্মান যামুই না। ফিরতি প্লেনে ঢাকায় চলে আসব।

এরকম যখন ভাবছি তখন সেই লম্বা লোকটি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাগে ক্ষোভে আমি তার চেহারার দিকে না তাকিয়ে লক্ষ্য করি আমাকে ছাড়া সব যাত্রী প্লেনে উঠে গেছে। প্লেনের দরজায় দুজন অপরূপ সুন্দরী এয়ার হোস্টেস আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানি সেই গর্দভ আমাকে একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আরেকবার আমার পাসপোর্টের ছবি খুঁটিয়ে দেখে। একবার নাক দিয়ে পাসপোর্টের গন্ধ শুকে। আবার পকেট হতে ম্যাগনিফাইংগ্লাস দিয়ে ভিসা আসল নাকি নকল খতিয়ে দেখে। আমার সবুজ পাসপোর্ট বলেই কি না এরকম অপমান?

লজ্জা,অপমানে আমার মেজাজ তখন চরম। এটা যদি ঢাকা এয়ারপোর্ট হতো এতোক্ষনে তার নাক বরাবর দু’ চারটা ঘুষি বসিয়ে দিতাম। রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যেত। এদিকে প্লেনের দরজা বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। আমি যাব না সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এ সময় লোকটি ব্যর্থ মনোরথে পাসপোর্ট ফেরত দেয়।

– এক্সট্রিমলি স্যরি স্যার। ইটস মাই ডিউটি। স্যরি স্যার এগেইন।হ্যাভ এ নাইস জার্নি স্যার।

পাকিটার মুখে স্যরি টরি শুনে আমার মাথায় খুন চেপে গেল।

ইউ ব্লাডি হোয়াই ডিড ইউ হ্যারেসড মি? এজ এ বাংলাদেশী? সান অফ বিচ, ডোন্ট ফাক ইউ…

লোকটা কোন কথা বলে না। নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে।

আরো কি কি যেন বলেছি মনেও নেই। লোকটির ভাগ্য ভালো আমার রাগান্বিত চেহারা দেখে এয়ার হোস্টেসদের একজন দ্রুত আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।

কুল মি: হাসান, গো হারি উইথ মি।এভরিবডি ওয়েটিং ফর ইউ।

পাকি সিকিউরিটির ভাগ্য ভাল বলতে হবে। এয়ার হোস্টেসের মিস্টি হাসি আমার সমস্ত রাগকে পানি করে দিয়েছে । না হলে তাকে আরো দু’চারটা অকথ্য গাল মন্দ শুনতে হতো।

শেষ পর্যন্ত  ফ্রাংকফ্রুট এসেছি অনেক ঝক্কি ঝামেলার মধ্য দিয়ে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় বিমানবন্দরের ফর্মালিটিজ সেরে পাঁচমিনিটের মধ্যে বাহিরে এসেই সিগারেট ধরাই। এসে যখন পড়েছি ধীরে সুস্থে আমার আপাতত গন্তব্য ভিসভাডেনে যাওয়া যাবে।

ভিসভাডেন হচ্ছে মধ্য পশ্চিম জার্মানির একটি শহর এবং হেসি রাজ্যের রাজধানী।ফ্রাংকফ্রুট, ডারমস্টাডট এবং মাইনজের পার্শ্ববর্তী খুব ছিমছাম শান্ত শহর।

এখানে আমার বাল্যবন্ধু বাপীর বড় দুইভাই আরিফ ও আসিফভাই থাকেন। তাদের জাপানী ফুডসের ব্যবসা, সুশি ওয়ান। প্রতিষ্ঠানটির খুব নামডাক। বেচাকেনাও বেশ। সব সময় লোকজনের আনাগোনায় গমগম করে।

এর আগে একবার ভিসভাডেনে ছিলাম মাত্র তিনদিন। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়িয়েছি। রাত হলে আসিফভাইয়ের সাথে ক্লাবে। ডিজে পার্টি কিংবা স্পোর্টস বারে সময় কেটেছে। এবার দু’দিন থেকে আবার ফ্রাংকফ্রুট ফিরতে হবে।

৩০ এপ্রিল সকালে হোটেল ইন্টারকনে অনুষ্ঠিত হবে ইউরোপিয়ান আর্ক -এর এওয়ার্ড সিরেমনি।

বাংলাদেশ থেকে  ৩ টি গ্রুপ অফ কোম্পানির সিইও,  চেয়ারম্যান আসবেন।  রহিম আফরোজ, এসএসবিসিএলসহ ৩টি কোম্পানিই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। ইউরোপীয়ান আর্ক আয়োজিত এওয়ার্ড সিরেমনি কাভার করে আমার ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান মিউনিখে। সেখানে আমার পাড়ার এক বড়ভাই থাকেন।

কলেজ জীবনের বন্ধু স্বপনের সাথে আড্ডা  ও আসিফভাইয়ের সাথে রাতদিন ঘুরে ফিরে ভিসভাডেনে আমার দু’টি দিন নিমিষেই কেটে যায়।

ত্রিশ এপ্রিল খুব সকালে আরিফভাইয়ে গাড়িতে ফ্রাংকফ্রুট চলে আসি।হোটেল ইন্টারকনের হলরুমে সকাল দশটায় শুরু হবে ইউরোপীয়ান আর্কের এওয়ার্ড গিভিং প্রোগ্রাম। সারাবিশ্বের ৬০ টি দেশের র্শীষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসেছেন  ও বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা এসেছেন অনুষ্ঠান কাভার করতে। আয়োজকরা আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য হোটেল ইন্টারকন ও  হিলটনে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। ইন্টারকনের ১৪ তলায় ৭০৯ নাম্বার রুম আমার জন্য বরাদ্দ ছিল ।

ঠিক পৌনে দশটায় আমার স্বভাব বিরুদ্ধ কেতারদুস্তর পোষাকে ফিটফাট বাবু সেজে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাই।৬০ টি দেশের আমন্ত্রিত অতিথিদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের অসংখ্য গনমাধ্যমকর্মী এসেছেন। পুরো হলরুম গমগম করছে। এতো মানুষের ভীড়ে আমার দু’চোখ খুঁজে ফেরে বাংলাদেশের আমন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের অতিথিদের। একসময় পেয়ে যাই ঢাকা হতে আগত এসএসবিসিএলের চেয়ারম্যান ও সিইও মিঃ সুমন তালুকদারকে। এতো বড় ইভেন্ট কাভার করতে এসে ভীষন নার্ভাস ছিলাম। তাকে পাওয়ায় যেন কিছুটা সাহস ফিরে পাই।

আগেই বলেছি, এবার তিনটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান পুরস্কৃত হয়েছে। জার্মানে উচ্চ শিক্ষায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ সৃস্টিতে অবদান রাখায় পুরস্কৃত  হয়েছেন মিঃ সুমন তালুকদার ও তার প্রতিস্টান এসএসবিসিএল। সম্মাননা লাভ করেন রহিম আফরোজ ও আরেকটি পোষাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।

আমন্ত্রিত অতিথি  ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ইউরোপীয়ান আর্ক ইন্টারকন হোটেলে রাতে নৈশভোজের আয়োজন করে। আমার নির্ধারিত ডিনার টেবিলে ছিলেন নাইজেরিয়ার তেল ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী, কাতারের শিক্ষা উপমন্ত্রী ও মরক্কোর একজন সাংবাদিক। তাদের সাথে ডিনারের সুযোগ পাওয়া আমার মতন ক্ষুদ্র একজন মানুষের জন্য ছিল বিশাল সম্মান ও প্রাপ্তির।

পরেরদিন ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য ফ্রাংকফ্রুট সিটি ভ্রমনের ব্যবস্থা। কিন্তু সকাল থেকেই দেশের জন্য এবং মায়ের জন্য ভীষন মন খারাপ লাগে। আমি সিটি ঘুরে দেখার আগ্রহ পাই না। সমস্ত প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে রুমে শুয়ে থাকি। দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠি।

আমার মন খারাপ জেনে সুমনভাই জোর করে নিয়ে যান ব্রেকফাস্ট টেবিলে। কফিপান করতে করতে তাকে বলি, আমি কালই ঢাকায় ফিরে যেতে চাই। আমার টিকেট চেঞ্জ করার ব্যবস্থা করে দেন।

আমার কথা শুনে সুমনভাই অবাক হয়ে জানতে চান, কি বলেন! মাত্রই এলেন, এক্ষুনি ফিরে যেতে চাচ্ছেন কেন? দু’চারদিন ঘুরে ফিরে তারপর না হয় ঢাকায় যাবেন।

তিনি আমাকে নানানভাবে বোঝানোর চেস্টা করেন, বারবার  সুযোগ আসে না রনি। কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করলে মন ভাল হয়ে যাবে।

কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল। পহেলা মে ঢাকায় ফিরবোই। টিকেট চেঞ্জ করতে যতো পেনাল্টি লাগে দিব,তারপরও একমুহুর্ত বিদেশ থাকবো না।

ফিরে যাবার সিদ্ধান্তে আমাকে অনড় দেখে সুমনভাই হাল ছেড়ে দেন। শুধুই বললেন, বুঝতে পারছি আপনাকে হোমসিকনেস কাবু করে ফেলেছে । দেখেন টিকেট চেঞ্জ করা যায় কিনা।

দুপুর এগারোটার মধ্যে একশ পঞ্চাশ ইউরো পেনাল্টি দিয়ে রির্টান টিকেট চেঞ্জ করে ফেলি। একুশ দিনের ট্যুর প্ল্যান সংক্ষিপ্ত করে মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই ঢাকায় ফিরে যেতেই মা ভীষন অবাক হয়েছিলেন। একই সাথে আমার অফিস কলিগরাও অবাক হয়ে বলেছিলেন, তুমি কি সত্যি জার্মান গিয়েছিলে?

আশেপাশের সবার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য লাগে।

তাদের কিভাবে বোঝাই, হোমসিকনেস আমাকে দেশে টেনে এনেছে!

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent