শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

অলকানন্দা জলে ভেসে যাওয়া কবি সাহিদুল আলম টুকু

২০০৩ সাল। কথাশিল্পী সাদ কামালী একদিন ফোন দিয়ে বললেন – সাহিদুল আলম টুকু নামে একজন কবি এসেছেন। কবি ইকবাল হাসান ও আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। একদিন সন্ধ্যায় ক্যাসল ফ্রাঙ্ক সাবওয়ে স্টেশনে কবিকে আসতে বললাম। ক্যাসল ফ্রাঙ্ক সাবওয়ে থেকে কবিকে নিয়ে গেলাম ডানফোর্থে। সেখানে একটি ক্যাফেতে কবি ইকবাল হাসানও এলেন। গল্প শুরু হলো। মধ্যরাত পার হলো। শেষ রাতে কবিকে নিয়ে আমার বাসায় এলাম। আবার গল্প। রাত শেষ হয়ে গেলো। আমাদের গল্প শেষ হলো না। শুরু হলো গান-

- Advertisement -

সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশী নায়ে,

তাহারি রাগিনী লাগিল গায়ে।।

সে সুর বাহিয়া ভেসে কার

সুদূর বিরহবিধুর হিয়ার

অজানা বেদনা, সাগরবেলার অধীর বায়ে

বনের ছায়ে।।

তাই শুনে আজি বিজন প্রবাসে হৃদয়মাঝে

শরৎশিশিরে ভিজে ভৈরবী নীরবে বাজে।

ছবি মনে আনে আলোতে ও গীতে

যেন জনহীন নদীপথটিতে

কে চলেছে জলে কলস ভরিতে অলস পায়ে

বনের ছায়ে।।

[ পরবর্তীতে টুকুর কণ্ঠে দু’তিনটি গান শোনার লোভে কত কত গভীর রাতের শেষ প্রহরে তাকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী কোন কোন শহরে চলে গিয়েছি! ]

গান শেষ হলে শুরু হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ ও জয় গোস্বামীর কবিতা।

জয়ের একটি কবিতা সাহিদুল আলম টুকুর শুধু প্রিয়ই নয়, এই কবিতাটি যেন তার জীবনের প্রবল আনন্দের অন্যতম উপাদান।

অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে

হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে

করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো

লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে

যে একা ঘুরছে তাকে খুঁজে বার করো

করেছ, অতল; করেছিলে পড়ে হাত থেকে লিপিখানি

ভেসে যাচ্ছিল, ভেসে তো যেতই মনে না করিয়ে দিলে

-‘পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকতো-সে-লেখা তুলবে বলে

কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।

জয় গোস্বামীর এই বিখ্যাত কবিতাটি আমি বহুজনের উচ্চারণে শুনেছি। কিন্তু কবি সাহিদুল আলম টুকুর উচ্চারণ হৃদয় উৎসারিত। যেন তারই পরশপাথরের অতলকে অতলডুবে স্পর্শ করতে গিয়েও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। হারিয়ে যাওয়া মার্বেল পাথরে যে বহুমূল্য রত্নের হীরকদীপ্তি লুকিয়ে ছিল, তা হারানোর শোক ও নিরব আর্তচিৎকার যেন টুকুর উচ্চারিত এই কবিতার প্রতিটি শব্দের গায়ে লেপ্টে থাকতো। টুকুর হাতের শিরা হৃদয় তন্ত্রির উদ্ভাসিত আলো কেঁপে কেঁপে উঠতো তার উচ্চারণে শক্তির সঞ্চারে!

রাত এবং দিন কীভাবে একাকার হয়ে সময় চলে যায়, টের পাইনা। ঘুম আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে বাঁচে। যেন অনেকদিন পর প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে হাওয়া বাল্যকালের কোন বন্ধুকে ফিরে পাই আমরা পরস্পর। আমরা উদ্দাম, লাগামহীন, আবেগ উচ্ছ্বাসে ভরপুর।

২.

বেশ কিছুদিন পর সাহিদুল আলম টুকুর ছোট ভাই টরন্টো বেড়াতে এলো। সে নিউইয়র্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভাইয়ের কাছে এসেছে বেড়াতে। আমার বাসায় তাদেরকে নিমন্ত্রণ করলাম। বাংলাদেশের গ্রামের মায়ের হাতে রান্নার স্বাদের মতো করে পাতলা ঝোল দিয়ে মাছ রান্না করলাম। কচিপাতাসহ মুলা টুকরো করে মাছ দিয়ে ঝোল বানালাম। সাতকড়া দিয়ে মাংস। আমার আনন্দ আর ধরে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভাইকে নিয়ে টুকুর পারস্পরিক আলোচনা আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। কোন অজানায় অন্য মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া একটি ভাই আমার নিজেরও ভাই হয়ে যায়।

কোন একদিন এক দৈববশে কবি সাহিদুল আলম টুকু আমার প্রতিবেশী হোন। এখন সামান্য একটা কিছু রান্না করলেই ডাক দেই – কবি, চলে আসুন। কাঁঠাল কিনে আনলে তাকে ছাড়া খেতে পারিনা। কবির একটি ছেলে অশেষ। সেও আমার ছেলে প্রহরের বন্ধু।

৩.

টুকু পড়েছেন অর্থনীতি বিষয়ে। কিন্তু অর্থের ব্যাপারে বৈষয়িক ভাবনা তার মাথার চৌহদ্দির মধ্যে নেই। তার মাথার ভিতরে কবিতা। এক অনুচ্চারিত ধ্বনির জাদুময় ছন্দ ও মাতাল সঙ্গীত। আপনার পাশে থেকেও তিনি নেই৷ আবার একেবারে না থেকেও অনেকখানি জুড়ে প্রবল তার উপস্থিতি। একটি বর্ণও বাড়তি উচ্চারণ করেন না টুকু। না জীবনযাপনে, না তার লিখিত কিংবা অলিখিত কবিতায়।

এই যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম, এরকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ আমাদের চারপাশে বিরল নয়। এরকম গুণের মানুষেরও অভাব নেই। রবীন্দ্রনাথের গান জানা এরকম মানুষও আছেন যত্রতত্র। তাহলে এতো গল্প বলে টুকু আলাদা কেন? টুকু আলাদাই। আলাদা কারণেই৷

৪.

সাহিদুল আলম টুকুর একটি হৃদয়পুর আছে। কলকাতা থেকে বনগাঁ কিংবা রানাঘাট যাওয়ার পথে দমদম থেকে পরের স্টেশন মধ্যমগ্রাম। মধ্যমগ্রামের পরের স্টেশন হৃদয়পুর৷ হৃদয়পুরের পরের স্টেশন বারাসাত। হৃদয়পুরে কবি ও লিটলম্যাগ সম্পাদক সুশীল সাহা থাকেন। সুশীল সাহা বাংলাদেশের মানুষ। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। স্বাধীনতার পর সুশীল সাহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে এসেছেন৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই সুশীল বাবুর সঙ্গে কবি সাহিদুল আলম টুকুর পরিচয়৷ তারপর পরস্পরের নিমন্ত্রণে এপার ওপার যাওয়া আসা। টুকু সুশীল সাহার সকাশে হৃদয়পুরে যান। সুশীল সাহা তাকে কলকাতার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ ডাকসাইটে মহারথীদের কাছে নিয়ে যান৷ টুকু হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে তাঁদের উষ্ণ সান্নিধ্য নিয়ে এসে আমাদের মাঝে বিলিয়ে দেন। কিন্তু টুকুর হৃদয়পুর বলতে আমি সুশীল সাহার সেই মধ্যমগ্রাম ও বারাসাতের মাঝখানের স্টেশন হৃদয়পুরের কথা বলছি না। আমি বলছি কবি সাহিদুল আলম টুকুর হৃদয়ে চির জাগরূক এক সবুজ মায়াভরা হৃদয়পুরের কথা!

৫.

কবি সাহিদুল আলম টুকুর হৃদয়পুরে রাস্তাটা এরকম –

‘ যদি যান,

কাউতলী রেলব্রিজ পেরুলেই দেখবেন

মানুষের সাধ্যমত

ঘরবাড়ি।

চাষা হাল বলদের গন্ধে থমথমে

হাওয়া।

কিষাণের ললাটরেখার মতো নদী,

সবুজে বিস্তীর্ণ দুঃখের সাম্রাজ্য।

দেখবেন, লাউয়ের মাচায় ঝোলে

সিক্তনীল শাড়ির নিশেন।

শুঁটকির গন্ধে পরিতৃপ্ত মাছির আওয়াজ।

দেখবেন ভাদুগড়ের শেষ প্রান্তে

এক নির্জন বাড়ির উঠোনে ফুটে আছে

আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসবতী

একই ম্লান দুঃখের করবী!

[ রাস্তা : আল মাহমুদ ]

আল মাহমুদের রাস্তা কবিতাটির বর্ণনা চিত্রের আবহমান বাংলার মাটিমাখা বাস্তব জায়গাটি এখনো হয়তো বাংলাদেশের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে পাওয়া যাবে। তবে এর স্থায়ী একটি আসন আছে কবি সাহিদুল আলম টুকুর হৃদয়ে। যেখানে গ্রামের বর্ণনা আঁকা নেই, কিন্তু এর সারল্য আছে। শুঁটকির গন্ধে পরিতৃপ্ত মাছির ভনভন নেই, কিন্তু প্রকৃতি সঙ্গীতের অপার শক্তির সুর আছে৷ কিষাণের ললাটরেখার মতো নদীটি নেই, কিন্তু নদীর চিরপ্রবাহমানতার স্নিগ্ধ সৌন্দর্যময়ী গতিটি আছে। যা কিছু সাধ্যমত সুন্দর, সেই সৌন্দর্যের অবাধ্য উচ্ছলতাটা আছে। কবি তিনি। সাহিদুল আলম টুকু তার নাম।

৫.

সাহিদুল আলম টুকু ও আমি দীর্ঘদিন একই এলাকায় বাস করি। আমাদের প্রায় পাশাপাশি দুটি বাসা। একই জায়গায় দু’জনে আড্ডা দিলে শেষরাতে একসাথে বাসায় ফিরি। কিন্তু যেরাতে একা আসি জেরার্ড এবং সেকভিল স্ট্রীটে স্ট্রীটকার থেকে নেমে সাহিদুল আলম টুকুর বাসার সামনে দিয়ে আমার বাসায় আসতে হয়। গভীর রাতে একাকী হেঁটে আসতে আসতে তার বাসার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি- এই বিল্ডিং-এ একজন কবি বাস করেন। আহা, কবিতো সর্বংসহা দ্রষ্টা! অনেকসময় কিছু বলেন না, কিন্তু ঠিকই টের পান বাতাসে উড়া পাখিটিও দূরে উড়ে যাওয়ার আগে পালক ফেলে একটি চিহ্ন রেখে যায়।

কিন্তু কবি সাহিদুল আলম টুকুর একটি কবিতা পাঠ করে আমি স্তম্ভিত। নির্বাক। একেবারে যতিচিহ্নহীন আয়নার মতো এমন অবিশ্বাস্য রকমের স্পষ্ট তীব্র আবেগের হৃদয় উৎসারিত মহাপ্রলয়সৃষ্টিকারী ঢেউয়ের উৎসপ্রাণের পরমাণু কণাকে যেন বেঁধে দিয়েছেন-

আমার কেউ নেই

কেউ আমায় খোঁজে না

তাই আমার হারানোর কোন প্রশ্ন ওঠে না

আমার কেউ নেই

কবি সাহিদুল আলম টুকুর এই কবিতা পড়ে আমার ভিতরে এক মহাজাগতিক সত্য সামনে এসে দাঁড়ায়। যে মহাবিস্ফোরণের ফলে এই মহাবিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ত চক্রের আয়োজনে একরত্তি সবুজ গ্রহের মানুষ আমরা; সেই ক্রমচক্রের পরিণতির এক পর্যায়ে অনিবার্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পথে আসলেই কি আমারও কেউ নেই! কবি এবং কবি ছাড়া আর কে বলতে পারেন এমন অমোঘ নিরেট সত্যের দর্শন বাণী!

সাহিদুল আলম টুকু একজন কবি। এই টরন্টো শহরেই তার বসবাস।

 

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent