বুধবার - এপ্রিল ২৪ - ২০২৪

শামীম আজাদ : মেধার দীপ্তির সঙ্গে সৌন্দর্যের দ্যুতি

শামীম আজাদ মেধার দীপ্তির সঙ্গে সৌন্দর্যের দ্যুতি

জীবন খুব অবিবেচকের মতো নিষ্ঠুর কানামাছি খেলতে চেয়েছে, কানামাছি খেলেছে কবি শামীম আজাদের সঙ্গে। হাসিমুখেই সেই কানামাছি খেলায় অংশ নিয়েছেন শামীম আজাদ। পর্যুদস্ত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু পরাজিত হননি। লড়াইটা জারি রেখেছেন। দিন শেষে শামীম আজাদ সেই কানামাছি খেলায় জয়ী হয়েছেন। সম্পূর্ণ নতুন একটা জীবনই শুরু করেছেন।

নতুন একজন বন্ধু পেয়েছেন তিনি। ভালোবাসার বন্ধু। আনন্দের বন্ধু। অভিমানের বন্ধু।

- Advertisement -

নতুন একজন সঙ্গী পেয়েছেন তিনি। ভালোবাসার সঙ্গী। আনন্দের সঙ্গী। অভিমানের সঙ্গী।

জীবন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ দু’জন বয়স্ক মানুষ, দু’জন মানব মানবী, যদি একসঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আমাদের অদ্ভুত হীনমন্য সমাজ এবং সমাজের মানুষগুলো তার শত বছরের ভাঙাচোরা মেকি একটা ভ্যালুজের কামড়ে মুষড়ে পড়ার জন্যে ব্যকুল হয়ে পড়ে।

দু’জন মানব মানবীর, নারী-পুরুষের সম্পর্কটাকে আমরা সেকেণ্ডেরও কম সময়ে একটি বিশেষ সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ফেলি। সম্পর্কটাকে আমরা টেনে হিঁচড়ে বিছানায় নিয়ে তবেই

তৃপ্ত হই।

বাংলা ভাষায় খুবই কাছাকাছি উচ্চারণে দু’টি শব্দ আছে–শয্যা আর সজ্জা। এই শব্দ দু’টিকে গুলিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতা বিস্ময়কর এবং অভ্রভেদী।

একজন নারী আর একজন পুরুষের যে কোনো সম্পর্ককে আমরা ক্ষিপ্র গতিতে শয্যায় নিয়ে ফেলি। এই সম্পর্কটার যে স্নিগ্ধ পরিপাটি একটা রূপ বা সজ্জা আছে বা থাকতে পারে সেটা আমরা ভাবতেই পারি না। আমাদের কাছে তাই–নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই শয্যা। ওখানে আর কোনো সাজ বা সজ্জা নেই। কী লজ্জার ব্যাপার ভাবুন তো!

০২

খুব প্রাসঙ্গিক বলে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে উল্লেখ করি।

কথাশিল্পী রাহাত খানের সঙ্গে আমার সখ্য ছিলো দারুণ। আমরা দু’জন ছিলাম অসমবয়েসী বন্ধুর মতো। নব্বুই দশকের সূচনায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অডিটোরিয়ামে রাহাত খানের জন্মদিনের উৎসব সন্ধ্যায় আমিও ছিলাম একজন বক্তা। অডিটোরিয়াম পরিপূর্ণ ছিলো দর্শকে। সেই দর্শকদের মধ্যে দেশের বরেণ্য মানুষদের বিপুল উপস্থিতি ছিলো। শামসুর রাহমান ছিলেন সভাপতি। আমার বক্তৃতার পালা এলে উপস্থাপক আমাকে মঞ্চে আহবান করলে রস্ট্রামে দাঁড়িয়ে আমি আমার বক্তব্য শুরু করেছিলাম এভাবে–মাননীয় সভাপতি, সমবেত সুধি মন্ডলী এবং আমার বন্ধু রাহাত খান। এইটুকু বলার পর অর্থাৎ ‘আমার বন্ধু রাহাত খান’ শোনার পর মিননায়তন ভর্তি দর্শকদের অধিকাংশই বিস্ময়নেত্রে আমার দিকে তাকালেন। আমি সেটা নোটিশ করে রিপিট করলাম–আমার বন্ধু রাহাত খান বাক্যবন্ধটি। বললাম, রাহাত খানের সঙ্গে আমার বয়েসের ব্যবধানটা দেখছি অধিকাংশ প্রিয় মানুষই এমন বেকায়দা রকমের মান্যতা দিচ্ছেন যে অসমবয়েসী রাহাত খান যে আমার বন্ধু হতে পারেন সেটা আপনারা আমলেই নিচ্ছেন না। রাহাত খানকে দেখুন তিনি কিন্তু হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে আমার সম্বোধনকে সমর্থন দিচ্ছেন। বয়েসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি আমার মতো এক তরুণেরও বন্ধু হতে পেরেছেন, রাহাত খান পারেন তরুণদের বন্ধু হতে।

অতঃপর সবার আগে রাহাত খান করতালিতে মুখর হলেন। তাঁর সঙ্গে সহাস্যকরতালিতে যুক্ত হলেন মিলনায়তনভর্তি মানুষও।

এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর, আমাদের রাহাত ভাই হুট করে একটা বিয়ে করে ফেললেন। আমাদের প্রিয় ভাবী অনেক বছর আগেই রাহাত ভাইকে ফেলে পরপারে চলে গেছেন। রাহাত ভাইয়ের পুত্র আর কন্যারা পড়াশুনা করতে আমেরিকায়। রাহাত ভাইয়ের জীবন একলা একার জীবন। সেই সময়ে, ২০০০ সালের দিকে  একদিন হুট করে বিয়ে করে ফেললেন রাহাত ভাই।

চারিদিকে কানাঘুষা ফিসফাস। রাহাত খান এইটা একটা কাজ করলেন! হাঁটুর বয়েসী একটা মেয়েকে তিনি বিয়ে করে ফেললেন! শতকরা নিরানব্বুইজন মানুষ নিন্দামুখর। ইত্তেফাক ভবনে শিল্পকলায় বাংলা একাডেমি কিংবা প্রেসক্লাব সর্বত্রই একই বিস্ময়–রাহাত খান এইটা একটা কাজ করলেন!

টু বি ভেরি অনেস্ট, মন খারাপ হলো আমারও। মেয়েটা হাঁটুর সমান বয়েসী বলে নয়। আমার মন খারাপ হলো নীনা খান নামের আমাদের প্রিয় ভাবীটার জন্যে। যিনি খুব মানবিক এবং মায়াবতী একজন মানুষ হিশেবে বিখ্যাত ছিলেন আমাদের সাহিত্যের অংগনে।  একটা জীবন ভাবীকে অনেক জ্বালিয়েছেন রাহাত ভাই। রাহাত ভাইয়ের নানামুখী অনেক অত্যাচার সয়েছেন ভাবী। অন্তত তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন রাহাত ভাই এমনটাই বা এইটুকুই  চাওয়া ছিলো আমার। আর কিছু নয়।

চারদিকে কান পাতা দায়। নিন্দুকদের বিরামহীন ধারাবাহিক  সমালোচনা কটুক্তি আর অশ্লীল কদর্য ভাষা ও ভাবভঙ্গি শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে মহা বিরক্ত আমি রাহাত ভাইয়ের ওপর। ইত্তেফাকে গেলেও রাহাত খানের কক্ষে উঁকি দিই না। ফোন করি না তাঁকে। বলতে গেলে এড়িয়ে চলি প্রিয় রাহাত খানকে।

ঠিক এমনি সময়ে, এক দুপুর অতিক্রান্ত সদ্য বিকেলে প্রেসক্লাবে সামনে পড়ে গেলাম তাঁর। আমাকে দেখেই স্বভাব সুলভ হই হই করে উঠলেন–আরে কী অবাক কাণ্ড! তোমার সঙ্গে আমার যে দেখাই হচ্ছে না! আসো না নাকি ইত্তেফাকে?

খুব কম শব্দে উত্তর দিলাম–যাই। এবং যাই বলেই কথা থামাই। রাহাত ভাই আমাকে টানতে টানতে একটা টেবিলে নিয়ে যান। চায়ের অর্ডার করেন। ধোঁয়া ওঠা দুই কাপ গরম চা আমাদের সামনে। আমি চুমুক দিই না। রাহাত ভাই তাড়া লাগান–খাচ্ছো না কেনো?

চুমুক দিই। কিন্তু কথা বলি না কোনো।

রাহাত ভাই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন–তোমার কি মন খারাপ রিটন? কিছু কি হয়েছে? কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু আমি কিছু বলি না।

চা শেষ হয় আমাদের।

আমরা বেরুই প্রেসক্লাব ভবন থেকে। রাহাত ভাই বলেন–ওঠো গাড়িতে ওঠো।

আমি রাজি হই না–আপনি যান। আমি যাবো না।

–আরে তুমি তো বাড়িতেই যাবে! ইত্তেফাক থেকে ওয়ারি চলে যেও। এখন ওঠো।

আমি বসলাম রাহাত ভাইয়ের পাশের আসনে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমাদের গাড়ি তোপখানা রোড ধরে জিপিওর পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ দিয়ে এগোচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে খাবার দাবার রেস্টুরেন্ট দেখি। হামদর্দ দেখি। কিন্তু রাহাত খানকে দেখি না।

রাহাত ভাই বললেন–লক্ষ্য করছি তুমি কথা বলতে চাইছো না আমার সঙ্গে! তুমি কি আমার ওপর কোনো কারণে রেগে আছো? ক্ষুব্ধ তুমি আমার ওপর?

আমি তাকাই তাঁর দিকে। তিনি বলেন–আমি বিয়ে করেছি বলে কি তুমি ক্ষিপ্ত আমার ওপর?

এবার আমি জবাব দিলাম–হ্যাঁ। এটা আপনি কী করলেন রাহাত ভাই! কেনো করলেন! ভাবীর কথাটা একটুও ভাবলেন না!

রাহাত ভাই বললেন–তোমাকে আমি খুব আধুনিক একজন মানুষ বলে জানতাম। তুমি চারপাশের নিন্দামুখর এইসব অর্ধশিক্ষিত রুচিহীনদের পর্যায়ে কেনো নামিয়ে আনবে নিজেকে?! আশ্চর্য!

একবারও কি ভেবেছো তোমরা আমার কথাটা? তোমার ভাবীর মৃত্যুর পর থেকে, সারাদিন ইত্তেফাক প্রেসক্লাব এখানে ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বা রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন শুন্য বাড়িতে একলা একা মানুষ আমি। পুরো বাড়িটা ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই।

কোনো শব্দ নেই। বাড়িটা এক সময় কেমন কবরের মতো হয়ে যায়! কবরের নিস্তব্ধতায় আমি বসে থাকি। টিভি দেখি। পায়চারী করি। টেলিফোনে কিছুক্ষণ এর ওর সঙ্গে কথা বলি। রাত বাড়ার পর থেকে পরদিন সকাল এগারোটায় ইত্তেফাকে যাবার আগ পর্যন্ত আমি থাকি আধুনিক এপার্টমেন্টের মতো দেখতে কবরের অন্ধকারের নিস্তব্ধতায়! প্রায় বারো ঘন্টা কথা না বলে থাকতে থাকতে মাঝে মধ্যে মনে হয় কথা বলতেই ভুলে যাচ্ছি!

একবার ভাবো তো তুমি কদিন এসেছো বাসায়, আমার খোঁজ নিতে! আসোনি। বিয়ে মানেই কি শুধু যৌনতা নাকি? আরে বাড়ি ফেরার পর ঝগড়া করার জন্যেও তো একজন মানুষ লাগে!

‘বাড়ি ফেরার পর ঝগড়া করার জন্যেও তো একজন মানুষ লাগে’ কথাটা শোনার পর আমি হাত বাড়িয়ে রাহাত খানের হাতটা ধরি–সরি রাহাত ভাই। এভাবে আমি তো ভাবিই নি! অথচ ভাবা উচিৎ ছিলো আমার!

ইত্তেফাকে গিয়ে সেদিন রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে থাকলাম আরো একটি ঘন্টা।

০৩

স্বামী মিঃ আজাদের মৃত্যুর পর একেবারেই একা হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের শামীম আপা। তাঁর ছেলে মেয়েরা অন্য শহরে নিজেদের সংসারে ব্যস্ত। একলা একা শামীম আপা কেমন আছেন কেমন থাকেন আমরা খোঁজ রাখিনি কেউ। মিঃ আজাদের মৃত্যুর খবরে ফোন করেছিলাম তাঁকে মনে আছে। অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি–রিটনরে আমি একা হয়ে গেলাম রে ভাই!

ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকছিলেন আপা। আমিও চাইছিলাম তিনি ব্যস্ত থাকুন। তাহলেই ভালো থাকবেন তিনি। একবার তিনি জল বিষয়ক কোনো একটা প্রজেক্টের জন্যে আমার কাছে ছোট্ট দু’টো ছড়া চাইলেন। দ্বিভাষিক একটা প্রকাশনা হবে। আমি অতিদ্রুত ক্ষিপ্র গতিতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দু’টো ছড়া লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

টেলিফোনে টুকটাক কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এর বাইরে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না।

শামীম আপা আর আমার কমন বন্ধু বাংলাদেশের একজনের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিলো। ফেসবুকে শামীম আপার সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও পোস্টের বিষয়ে সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো–যেখানে তাঁর সঙ্গে আরেকজন বিদ্বান ও প্রজ্ঞাবান মানুষের ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি বিদ্যমান।

সেই মানুষটা শিক্ষাবিদ ডক্টর সেলিম জাহান। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিটিভির শাদাকালো আমলে একটি কুইজ অনুষ্ঠানের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থাপক হিশেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

আমাদের কমন বন্ধুটির ফোন করার সময়টায় শামীম আপার সঙ্গে তাঁকে প্রায় নিয়মিতই ভিডিও পোস্টে এক ফ্রেমে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে কথা বলতে দেখা যেতো।

বন্ধুটি সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে খানিকটা বিস্ময় মিশ্রিত টিপ্পনির সুরে বললো–এই বয়েসে শামীম কী সব করছে দেখেছো! আচ্ছা ওরা বিয়ে করেছে নাকি? জানো কিছু?

বন্ধুটির মনোভঙ্গী বুঝতে পেরে আমি বললাম–দু’জন নিঃসঙ্গ মানুষ যদি এই বয়েসে এসে পরস্পরের বন্ধু হয়, ঘনিষ্ঠ হয় তাতে তোমার আমার সমস্যা কি? এমনকি তাঁরা যদি বিয়েও করে কিংবা না করে তাতেই বা আমাদের কি? জীবনটা তাঁদের। তাঁদের বাকি জীবনটা তাঁরা কিভাবে কাটাবেন সেটা তাঁরাই ডিসাইড করুক না! তুমি খামোখা টেনশন নিও না। আমি চাই একা হয়ে যাওয়া আমাদের নিঃসঙ্গ শামীম আপা ভালো থাকুক।

বন্ধুটি মেনে নিয়েছিলো আমার যুক্তি। সেও বলেছিলো হ্যাঁ ওরা ভালো থাকুক।

০৪

গেলো আগস্টে স্বস্বামী শামীম আপা কানাডার হেমিল্টনে  এসেছিলেন তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে। ওখান থেকে টরন্টোয় এসে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডাও দিয়েছেন। প্রথমে বলেছিলেন অটোয়ায় আসবেন। কিন্তু পরে মত পাল্টালেন, আসবেন না। তারপর আবার মত পরিবর্তন–আসবেন। আমি হাসি আহারে আমার অস্থির চঞ্চল শামীম আপা…! এই না হলে কবি!

০৯ জুলাই মেসেঞ্জারে শামীম আপা লিখলেন–কানাডার কোন শহরে থাকিস কে ভাই? আমি আর সেলিম আগস্টের ৩য় সপ্তাহে হেমিলটন থাকব।

–আসো আসো।

আমি অটোয়ায় থাকি।

তোমার বন্ধু মহসিন রেজাও একই শহরে।

………

বাহ

তুমি যে ওর কন্যার বিয়েতে গেছিলে জানতাম। কিন্তু ধারণা ছিল,  তুমি টরান্টতে!……

–আমি আর সেলিম সে অপেক্ষায় আছি। অটোয়ার আকর্ষণ বেলী, শার্লি, রেজা ও তুমি এবং সেলিমদের এক প্রিয় দম্পতি।

এরপর আগস্টের ২৮ তারিখ সকালে জানালেন–শুভ সকাল শার্লি- রিটন

আমরা তোমাদের শহরে। তোমাদের দেখিতে আসিয়াছি!

একটা ঝটিকা সফরে তাঁরা অটোয়া এলেন হাতে মাত্র দুইটা দিন নিয়ে। একটা দিন আমাদের জন্যে বরাদ্দ রাখা। সেদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা টানা সাড়ে সাত ঘন্টা আমরা আফরোজা বানু আর মহসিন রেজার পুত্র আবীরের অটোয়ার বাড়িতে কাটালাম।

আহা সহপাঠী মহসিন রেজাকে পেয়ে আনন্দে টগবগ করছে শামীম আজাদ। বন্ধু মহসিনকে জড়িয়ে ধরেই টলটলে তাঁর চোখ। আফরোজা বানু-শার্লি আর আমাকে ধরেও কেঁদে চোখ ভাসালেন আপা। কী আবেগ তাঁর চোখে মুখে পুরো দেহভঙ্গিতে!

দ্বিপ্রাহরিক আহার পর্ব পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিলেন স্বস্ত্রীক শিশির দত্ত।

কথায় আড্ডায় খানাখাদ্যে স্মৃতিচারণে ঘড়ির কাঁটা লাফাতে লাফাতে কখন যে সাড়ে সাত ঘন্টা অতিক্রম করে ফেলেছে!

বিদায়ের সময় আরেক প্রস্ত অশ্রুপাত মায়াবতী শামীম আজাদের।

পুরো আড্ডায় লক্ষ্য করেছি, সেলিম জাহান সারাক্ষণ খেয়াল রাখছেন কিসে আপা খুশি হন আনন্দিত হন সেইদিকে। এমন একজন প্রেমময় সঙ্গী পেয়েছেন আপা, দেখে আমরাও আনন্দে ভাসি।

লণ্ডনে ফিরে গিয়ে শামীম আপা লিখলেন

–রিটন প্রাণ ভরিয়ে এলাম।

অনেক আদর দিলাম শার্লিকে।…

–কখনো পাঠিয়ে দিতে পারিস আমাদের কাছেও।

নদীকে দেখলাম না কিন্তু ওর গল্প শুনে মন ভরে এলাম।

শুধুই রেজারা ও তোদের জন্য যাওয়াটা অপরিহার্য ছিলো।

জীবন সচল থাকতেই জীবনের আত্মীয়দের গায়ে পরশ বুলাতে হয়। এ উপলব্ধি আবারও হল।

শামীম আপা

জবাবে আমি লিখলাম–তোমাকে কাছে পেয়ে আমরাও খুবই আবেগাপ্লুত ছিলাম।

খুব কম সময়ের জন্যে হলেও এই দেখা হওয়াটা প্রবাসের নিস্তরঙ্গ জীবনকে মধুময় করে তুলেছিলো।

আবার এসো আপা তোমার ভালোবাসার চমৎকার সঙ্গীটিকে সঙ্গে নিয়ে।

০৫

কবি শামীম আজাদের নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ মরুভূমির মতো শুকনো একঘেঁয়ে জীবনে শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসেছেন একজন সেলিম জাহান। শামীম আজাদের জীবন বৃক্ষটি এখন পত্রপল্লবে সবুজের সমারোহে মুখরিত। রাহাত খানের বলা সেই–বাড়ি ফেরার পর ঝগড়া করার জন্যে অন্তত একজন মানুষ আছে শামীম আপার।

মেধার দীপ্তির সঙ্গে সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়ানো শামীম আজাদের।

প্রিয় শামীম আপা,

গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার সেই কবে একটা গান লিখে রেখেছেন তোমাদের কথা ভেবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে দ্বৈত কণ্ঠে সেই গানটা গেয়েছিলেন কিশোর কুমার ও রুমা গুহঠাকুরতা। গানটা আমার ভীষণ প্রিয়। প্রায়ই শুনি। এই যে এখন তোমাকে নিয়ে ল্যাপটপে লিখতে বসেছি যখন, আমার সেলফোন থেকে টিভি স্ক্রিনে ট্রান্সফার হয়ে গানটা বেজে চলেছে। গানের প্রথম কলি–এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে…।

১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লুকোচুরি’ সিনেমায় সেটায় লিপসিং করেছিলেন কিশোর কুমার এবং মালা সিনহা।

প্রিয় শামীম আপা, ১১ নভেম্বর তোমার জন্মদিনের উৎসবে কোনো একটা সময়ে, আমি চাই এই গানটা শুনবে তোমরা দু’জনে, পাশাপাশি কিংবা মুখোমুখি বসে। তোমার এবারের জন্মদিনে এটাই আমার উপহার তোমাদের জন্যে–

[এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে

এই জীবনে যে ক’টি দিন পাবো

তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাবো দোঁহে

স্বপ্ন মধুর মোহে…

কাটবে প্রহর তোমার সাথে

হাতের পরশ রইবে হাতে

রইবো যেদিন মুখোমুখি মিলন আগ্রহে

স্বপ্ন মধুর মোহে…

এই বনেরই মিষ্টি মধুর শান্ত ছায়া ঘিরে

মৌমাছিরা আসর তাদের জমিয়ে দেবে জানি

গুঞ্জরনের নীড়ে আসর জমিয়ে দেবে জানি

অভিসারের অভিলাষে রইবে তুমি আমার পাশে

জীবন মোদের যাবে ভরে রঙের সমারোহে

স্বপ্ন মধুর মোহে…]

ভালো থেকো। জীবন জীবন্ত হোক তুচ্ছ অমরতা।

 

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent