শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

কর্পোরেট জগতে ঔপনিবেশিক ভূত

বৃটিশ শাসনামলের পর রাজা মহারাজা এবং জমিদারপ্রথা বিলোপ পেয়েছে। বিদায় নিয়েছেন বৃটিশদের আশির্বাদপুষ্ট রায় বাহাদুর এবং খান বাহাদুরগণ। কিন্তু তাদের লুপ্ত পদচিহ্ন এবং অশরীরি ছায়া কী এখনো রয়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশে? এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটা কখনো ভাবিনি। গত সপ্তাহে এক ঘরোয়া বৈঠকে ভবিষ্যত বাংলাদেশ এবং কর্পোরেট সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ জমেছিল। হঠাৎ একজন বন্ধু এই প্রশ্নটা করলেন। বিষয়টা আমাদের সবার মাঝে ভাবনার খোরাক জোগায়। আড্ডা আর তর্কে বেশ কিছু অন্তর্নিহিত বিষয় বেরিয়ে আসে। আমরা সকলে কিছুক্ষণের জন্য পেছনে ফিরে তাকাই। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখি কোথায় সেই অশরীরির আস্তানা।

- Advertisement -

জমিদারপ্রথা বিদায় নিলেও তার কিছু অলিখিত নিয়মকানুন রয়ে গেছে কোম্পানি প্রথায়। বেশিরভাগ জমিদারগণ ছিলেন বৃটিশদের আজ্ঞাবহ চাটুকার। ফলে তারা যখন গদিনসীন হতেন তখন বৃটিশদের রীতি প্রথার অনুকরণ করতেন এবং আত্ম¯øাঘা বোধ করতেন। বৃটিশরা বাঙালিদের বিশ্বাস করতেন না। এজন্য তৎকালীন ভারতীয় বা বাঙালিদের খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হতো না। প্রশাসনের ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে ডেপুটি মেজিস্ট্রেট। এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই সনাতনী ধর্মে পারিবারীক শ্রেণিপ্রথা চালু ছিল। বৃটিশরা এসে প্রবর্তণ করলেন প্রশাসনিক শ্রেণিপ্রথা। সীমারেখা টানা হল প্রশাসক এবং কারণীক গোষ্ঠীর মধ্যে। কারণীকরা সহজে যেন প্রশাসক হতে না পারে সেই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হল। লক্ষ্য করুন, আমাদেরই দেশ শাসন করে আমাদেরকে পদানত রাখার কি উত্তম ব্যবস্থা!

চালু করা হল প্রশাসক এবং কারণীকদের মধ্যে আনুগত্যের নামে চাটুকারীতার সংস্কৃতি। সেখান থেকেই প্রভুকে ‘স্যার’ ডাকার প্রবর্তন। এই ডরপুক কারণীক শ্রেণির ব্যক্তিত্বের বিকাশ তো হলোই না, এমনকি আত্মবিশ্বাসের অভাবে কর্মপ্রতিভাও সীমিত গÐির মধ্যে আটকে থাকলো। কারণীক শ্রেণি তো কেবল নির্দেশের আজ্ঞাবহ; প্রতিভার বিকাশ ঘটবে কিভাবে?

বৃটিশরাজ ভারতবর্ষ ছেড়ে বিদায় নেয়ার আগে স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফের টেনে দেয়া সীমারেখায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া দুই দেশ অথচ তিন খÐে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তৎকালীন পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানীদের উপনিবেশে পরিণত করে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের অর্থনীতিবিদ ড. মাহাবুবুল হক যে ২২টি ধনী পরিবারকে চিহ্নিত করেন তাদের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালি কোনো পরিবারের জায়গা হয়নি। এই ২২ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৬৬% শিল্প সম্পদ এবং ৮৭% ব্যাংকিং লেনদেন। সঙ্গত কারণেই তৎকালীন পূর্ববাংলাকে উপনিবেশ হিসেবে আরো দুইযুগ পদানত রাখা সম্ভব হয়েছিল। সেই সময়ে মুসলিম লীগের আবরণে একটি আজ্ঞাবহ শ্রেণি তৈরি হয়েছিল যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো তৎকালীন পূর্ববাংলা কখনো স্বাধীন হতে পারবে না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্বশাসনের দাবীকেও তারা সমর্থন করতে পারেননি। নিজেরা নিজেদের দেশের প্রশাসন চালাতে পারবো নাÑ এই পরনির্ভরশীলতার ভূত এখনো কোনো কোনো ঘরানার ঘাড়ে চেপে বসে আছে।

কৃষি থেকে শিল্পায়নÑ এই অর্থনৈতিক রূপান্তরে জমিদারপ্রথা বিলীন হয়েছে, এসেছে কর্পোরেট। ব্রিটিশ ভারতে দেশীয় কোম্পানি বা কর্পোরেশনের সূচনা করেন সম্ভবত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি লবণ, পাট, কয়লা এবং জাহাজের ব্যবসা করে অনেক অর্থ উপার্জন করেন। ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথ ‘ইউনিয়ন ব্যাংক অব কোলকাতা’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হন। এই দ্বারকানাথই তার এস্টেট পরিচালনার জন্য প্রথম একজন ইউরোপীয় ম্যানেজার নিয়োগ করেন। রাজা রামমোহনের মত সমাজসেবী এবং সামাজিক প্রথা সংস্কারকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্তে¡ও তিনি ছিলেন কঠোর মনোভাবের এবং মুনাফালোভী শিল্পপতি।

কষ্টকল্পিত নয়, অনুমান করা যায় দ্বারকানাথের সময়ে এস্টেট পরিচালনার জন্য হয়তো দেশীয় দক্ষ ম্যানেজারের অভাব ছিল। বাঙালি হওয়া সত্তে¡ও বাঙালি কোনো কারণীকের হাতে এস্টেটের দায়িত্বভার অর্পণে আস্থার অভাব ছিল। তারপর দুইশত বছর গত হয়েছে। বৃটিশ ভারত আর পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃংখল খুলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে পাঁচ দশক আগে। কিন্তু আমাদের শিল্পপতিদের সেই সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের কি পরিবর্তন হয়েছে?

এদেশে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ নিজেদের চারিপাশে একটা অদৃশ্য ব্যুহ তৈরি করেন। অধস্তন কর্মীদের কাছে তাতে করে উর্ধ্বতনের গুরুত্ব বাড়ে। এককালে জমিদারগণ প্রজাদের সাথে এই ধরনের বিভেদ তৈরি করে রাখতেন যাতে করে সহজে কেউ কাছে ধারে ভিড়তে না পারে। এতে করে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়Ñ সমাধান কখনোই পথ পায় না। এই সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব থেকেই এসেছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। অবিশ্বাস থেকে এসেছে এক কেন্দ্রীক ক্ষমতার চর্চা। ফলে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হয় শ্লথ এবং প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে পিছিয়ে পড়তে হয়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের আঁকা গ্যাড়াকলে পড়া গরুর গাড়ির সেই বিখ্যাত চিত্রকর্মটির কথা মনে পড়ে। যে গরুদ্বয় গাড়িটি টেনে নিয়ে যায় তারা যদি অপুষ্ট হয় তাহলে মালবাহী গাড়ি গ্যাড়াকলে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। সমরক্ষেত্রে যেমন পদাতিক বাহিনী হয় অগ্রগামী তেমনি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মূল চালিকাশক্তি হল বিপণন (বিক্রয়) এবং গ্রাহকসেবা বিভাগ। আর চার চাকা হল মানবসম্পদ, অর্থ ও হিসাব, ক্রয় ও সরবরাহ এবং অডিট ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। এখন যদি পদাতিক বাহিনী অর্থাৎ বিক্রয় এবং গ্রাহক সেবা কর্মীদের উপযুক্ত বেতন ও প্রনোদনা না দিয়ে সহকারী শক্তি চারচক্রের পেট ভারী হয় তাহলে গাড়ি ধীরে চলবে এবং গাড়ি গ্যাড়াকলে পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। তবে এটাও সত্য পদাতিক বাহিনী যদি গাধার উপর উপবিষ্ট হয় তবে সে কখনো ঘোড়ার নাগাল পাবে না। প্রতিষ্ঠানকে দক্ষ এবং কার্যকর করতে হলে এই ধরনের পশ্চাৎপদ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কর্মী প্রশিক্ষণ এবং প্রনোদনার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন, তাকে ব্যয় হিসেবে না দেখে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। গতানুগতিক ধারায় আমরা যন্ত্রপাতিকে সম্পদ হিসেবে দেখি। কিন্তু যন্ত্রের পেছনে যে মানব বসে কাজ করেন সে কিন্তু আরো বেশি মূল্যবান সম্পদ। একই মানের মেশিন দুইটি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান ক্রয় করে বিনিয়োগ করতে পারে। এখানে পণ্য মানের কোনো ভিন্নতা হবে না। কিন্তু কর্মীর দক্ষতা এবং যোগ্যতার উপর নির্ভর করে কোনো কোম্পানির পণ্য বেশি বিক্রি হবে। সুতরাং যন্ত্র নয়, বর্তমান সময়ে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ কর্মীরাই হল যেকোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ।

এখনও কোনো কোনো মহল মনে করেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বিদেশী হতে হবে, বিশেষত নেটিভ ভাষা ইংরেজি এবং সাদাবর্ণের হলে আরো ভাল হয়। আর যদি সেরকম কাউকে না পাওয়া যায় তাহলে নিদেনপক্ষে ভারতীয় এমনকি শ্রীলংকান হলেও মন্দ নয়! অথচ পশ্চিমা স্কুলে সুশিক্ষিত, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ অনেক প্রবাসী বা অনাবাসী রয়েছে যারা এই শূন্যতা পূরণ করতে পারেন। উপযুক্ত সম্মানী এবং উদ্যোগের অভাবে আমরা আমাদের এই প্রবাসী মানবসম্পদ কাজে লাগাতে পারছি না। বরং সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের কারণে স্বদেশী কর্মীদের বিদেশী প্রশাসকের অধীনে সোপর্দ করছি। এই ধরনের মানসিকতাকে সামন্ততান্ত্রিক অদূরদর্শীতা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে!

কানাডাতে আমি পাঁচ বছর বসবাস করেছি। এই সময়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশনে পড়াশোনা করেছি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজও করেছি। কিন্তু কখনও দেখিনি বিদেশ থেকে আমদানী করে কাউকে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা সত্তে¡ও বিদেশীদেরকে একটা পর্যায় থেকে শুরু করতে হয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠানে ডাইভারসিটি বা বহুজাতিক কর্মী অবশ্যই ইতিবাচক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। বিশেষত প্রযুক্তি বা টেকনিক্যাল বিষয়ে পারদর্শী বিদেশী কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু কখনোই কর্ণধার নয়।

বাংলাদেশে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য লাভ করেছে তারা বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করা স্বদেশী, অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং প্রতিভাবানদের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নিয়োগ করেই সফলতা পেয়েছে। যেই অর্থ বিদেশী কর্নধার আমদানীতে ব্যয় হয় সেই অর্থ কর্মী প্রশিক্ষণে কাজে লাগালে দক্ষ কর্মী এবং ব্যবস্থাপক তৈরি হবে। কর্মীরাও পাবে কাজ করার প্রনোদনা। যেই গাছ মহীরূহ, সেই গাছের শেকড়কেও সেই মাটির গভীরে প্রথিত হতে হয়। সেই কারণে শীতের দেশের আপেল এই দেশের মাটিতে ভাল ফলে না। সেরকম আবার বিপরীতক্রমে গরমের দেশের আম শীতের দেশে ফলে না। গাছের ক্ষেত্রে যেমন ভালো ফল ফলানোর জন্য মাটির উপাদান এবং আবহাওয়া গুরুত্বপূর্ণ,  তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিকাশে ভাষা এবং সংস্কৃতি তেমনি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। যেকোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইট, পাথর, রডের দালান আর আধুনিক যন্ত্রপাতির গুনে বিকশিত হয় না বরং দক্ষ কর্মী এবং ব্যবস্থাপকরাই মেধা, সময় এবং শ্রমের বিনিময়ে সম্পদ সৃষ্টি করে মুনাফা এনে দেয়। সুতরাং সেই কর্মীদের যিনি নির্দেশনা এবং প্রণোদনা দিয়ে বিকশিত করবেন তাকে হতে হবে অভিজ্ঞ, সুশিক্ষিত এবং স্বদেশী। বিদেশী কর্ণধার এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে, আবশ্যকীয় কখনোই নয়।

এদেশে কর্পোরেট জগতে কারণীক নয়, দক্ষ ব্যবস্থাপক প্রয়োজন যারা তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী। কর্মীদের কাজের পরিবেশকে করতে হবে আকর্ষণীয় এবং কর্মউদ্দীপক। অগ্রসরমান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চায় উদ্যমশীল এবং উদ্ভাবণী ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মী এবং ব্যবস্থাপক। সুস্বাস্থ্য আর প্রশান্ত মনের যোগফলে আসে কর্মউদ্দীপনা এবং প্রণোদনা। অগ্রগামী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আজকাল মানসম্পন্ন পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করে। গুগল তাদের কর্মীদের জন্য ব্যবস্থা রেখেছে বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরা আর খেলাধূলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক কর্মীদের হাসপাতালের ভেতরেই ‘ওয়েলনেস সেন্টারে’ যোগদানের জন্য উৎসাহিত করে। এইসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু আহরণ করার সময় এসেছে।

- Advertisement -

Read More

Recent