শুক্রবার - এপ্রিল ২৬ - ২০২৪

ঝুঁটি বাঁধা সেই মিষ্টি মেয়েটি

নাম তাঁর নিশুতি, আমরা ওকে ডাকি নিশু।

- Advertisement -

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন ইংরেজি বিভাগ থেকে পড়ানো হতো “সার্টিফিকেট ইন স্পোকেন ইংলিশ” নামে একটি অতিরিক্ত বর্ষ-মেয়াদী কোর্স। নিয়মিত পড়াশুনার পাশাপাশি আমিও নিই এই বাড়তি কোর্সটি। আর সেখনেই প্রথম দেখা পুতুলের মতো অদ্ভূত সুন্দর এই মেয়েটির সাথে। প্রথম ক্লাসে স্যার সবার পরিচয় নিচ্ছেনÑ সবাইকে ইংরেজিতে বলতে হবে তার নাম, কোন ইয়ারে পড়ে এবং কোন বিভাগের ছাত্র এই সব। নিজের পরিচয় বৃত্তান্ত ইংরেজীতে দিতে হবে এবং তাও পুরো ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে, এই ভেবে অনেকেরই জবান বন্ধ হয়ে গেলÑ অনেকেই হয়তো দাঁড়িয়ে নাম আর ইয়ার বলেই খালাসÑ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকছে, মুখে আর কোন কথা আসছে না। তবে আমার অবস্থা ভিন্নÑ কেন যেন অনেকটা ভাবলেশহীন। দুঃশ্চিন্তার কোন ছিটে ফোঁটাও নেই আমার চোখে মুখে। ভাবনা শুধু একটাই এবং সেটি হচ্ছে কখন মেয়েটি তার পরিচয় দেবেÑ কিভাবে সে কথা বলে সেটি দেখার।

অবশেষে এলো সেই ক্ষণÑ মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। আমার মনে হলো একটি জীবন্ত পুতুল নড়ে উঠেছে এবং অবলীলায় ফর ফর করে ইংরেজিতে বলে যাচ্ছে সব না বলা কথা। আমি নির্বাক তাকিয়ে থাকলাম পুতুলের দিকেÑ পুতুল কি করে এতো কথা বলে, তাও আবার ভিন দেশী এক ভাষায়। যদিও অদেখা ভুবনের এই ঘোর না কাটতেই এলো আমার পালা। ভাবছি কি করবোÑ কি বলবো?

হঠাৎ মনে পড়লো আমাদের ক্লাসের লিটনের কথা।

ভাবছি ইংরেজিতে এতো কথা না বলে বোর্ডে গিয়ে লিটনের মতো শুধু একটি ইন্ডিফারেন্স কার্ভ এঁকে সব না বলা কথা বলে দেই, বুঝিয়ে দেই সব কিছু জ্যামিতিক ভাষায়।

আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে।

মাইক্রো ইকনোমিক থিওরি ক্লাসেÑ টিকেসি (তৌহিদুল করিম চৌধুরী) স্যার এসেই চোখ কড়কড় করে শুধু পিছনের সারির দিকে তাকাচ্ছেন। বন্ধু নুরুল আনোয়ার তখন একটু অস্থির, যদিও স্যার যাকে ডাকলেন সে হলো আমাদের বন্ধু লিটন। সে এক অন্য ভুবনের মানুষÑ বড় ভাই কুদ্দুস সাহেব কোটিপতি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। তাঁর ধারণা এক সময়ে সেও হবে এই রকমই বিশাল এক শিল্পপতি। ক্লাসে আসা শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর সময় কাটানোর জন্যই। তবুও সে বীরদর্পে হেঁটে এলো ক্লাসের সামনে এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে চক-ডাস্টার হাতে নিল। ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছিল সুঠাম দীর্ঘদেহী এই লিটনই আমাদের ক্লাস টিচার আর এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট খাট আকৃতির টিকেসি স্যার হচ্ছেন তাঁর ছাত্র।

আগের ক্লাসে আমাদের পড়ানো হয়েছিল নিরপেক্ষ (ইনডিফারেন্স) রেখা আর সেই রেখাই আঁকতে বলা হলো লিটনকে। সেকেন্ডের মধ্যেই বোর্ডে রেখা একে ফেলল লিটন, যদিও ক্লাসের সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল বোর্ডের দিকে। কেউ কেউ কানা ঘুষা করলেও কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলল না। ভয় একটাই যদি আবার বোঝানোর জন্য তাকেও সামনে আসতে হয়। তবে অঞ্জলি, মিনু, জলি, রেহানা এবং ইসরাত সহ মেয়েদের অনেকেই মিটিমিটি হাসছিল। এরই মধ্যে মুনমুন ফিক ফিক করে একটু জোরেই হেসে দিল। তারুণ্য দীপ্ত এবং অবিবাহিত বলে স্যার ছিল মেয়েদের ব্যাপারে সর্বদাই একটু দুর্বলচিত্তেরÑ যদিও ইসরাতের উপর ছিল একটু বেশি দুর্বল। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে মুনমুনের দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব গম্ভীর করে স্যার বললেন “ ইউ স্ট্যান্ড আপ”Ñ হাসছেন কেন?

এনায়েত পাশ থেকে বাঁ হাতে খোঁচা দিচ্ছে। কোন জড়তা নেই, ভণিতা নেইÑ অতি নিঃসঙ্কোচে ফরফর করে বলে ফেলল মুনমুন। শেষটায় স্যার নিজেও হেসে ফেললেন।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডাক পড়ল আমারÑ

“আপনি আসুন! বলুন এটা কি এঁকেছে?”

আমি বললাম: স্যার! এটি ভুগোল। পৃথিবী যেমন বৃত্তাকার, লিটন সে রকমই একটি বৃত্ত এঁকেছেÑ যেটি আপাত দৃষ্টিতে দেখলে দুষ্ট চক্রের মতো মনে হয়। আমি একটি রেখাচিত্র এঁকে দেখালাম যে, নিরপেক্ষ রেখার স্বাভাবিক আকৃতি হয় ডান থেকে বামে নি¤œগামী এবং উত্তল।

স্যার বললেনÑ আপনি ঠিকই এঁকেছেন, তবে বলা যায় না দূর ভবিষ্যতের কথা। আজকে যা ভুলÑ কোন এক সময়ে সেটিই হয়ত ঠিক বলে প্রমাণিত হবেÑ ভোক্তার স্বাভাবিক আচরণ হয়তো অস্বাভাবিক হবেÑ কে জানে মানুষের চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ হয়ত এভাবেই বৃত্তাকার পথে আবর্তিত হবে।

আমি জানি না সেদিন আমরা কবে দেখব তবে আমাদের প্রিয় তৌহিদুল করম চৌধুরী (টিকেসি) স্যার দেখে যেতে পারেননি। আমাদের তিনি ছেড়ে গিয়েছেন অনেক দিন আগেইÑ আজ তিনি এক অন্য ভুবনের বাসিন্দাÑ শুয়ে আছেন শান্ত ভুবনে, চির নিদ্রায়।

- Advertisement -

Read More

Recent