শুক্রবার - মার্চ ২৯ - ২০২৪

বেসমেন্টে জ্ঞানপাপীদের জমাট আসর

 

ছবিজ্যানোন ফ্রি পিক

ছুটির রাতের বেসমেন্টের জমাট আসর

- Advertisement -

বিপুল খানাখাদ্যি এবং পাগলা পানি,

উজির মারার নাজির মারার অবাক বাসর

বিত্ত-বেসাত সবই খোদার মেহেরবানী…

বসত করি আম্রিকাতে পাতলু-মটু

আসছি হেথায় লিগাল কিংবা ইল্লিগালি,

কুড়িজনের ঊনিশজনেই ভীষণ পটু

বাংলাদেশকে দেবার ক্ষেত্রে খিস্তি-গালি…

আলোচনায় মিনিট পাঁচেক পরেই আসে

অভ্‌বিয়াসলি বাংলাদেশের প্রসঙ্গটা,

কণ্ঠে সবার দেশের প্রতি দরদ ভাসে

আর শুরু হয় গালাগালের ঘনঘটা…

শুরুটা হয় আওমী লীগের শাসন দিয়ে

মধ্যিখানে মেতে থাকি শেখ হাসিনায়।

দেশটা গেলো রসাতলে সেইটা নিয়ে

তুমুল আলাপ গড়িয়ে চলে তীব্র ঘৃণায়…

সমাপ্তিতে টার্ণ নেয় তা শেখ মুজিবে

শেখ মুজিবের শাসনকালটা কৃষ্ণ বিবর,

গালাগালের তুবড়ি ছোটে সবার জিভে

পাকিস্তানটা ভেঙেই দিলো শেখ মুজিবর…

বাংলাদেশকে গাল না দিলে ভাল্লাগে না

বাংলাদেশে আজকে কোনো মানুষ থাকে!

ইন্ডিয়া সব লইয়া গেলো, ক্যান নেবে না

হিন্দুগুলোই পায় প্রমোশন ঝাঁকে ঝাঁকে…

ঝান্ডা থেকে চান তারাটা কে খসালো?

পেয়ারা পাকিস্তান হামারা টুকড়া হুয়া!

স্বাধীন হবার আগেই আমরা ছিলাম ভালো

হুক্‌কা হুয়া হুক্‌কা হুয়া হুক্‌রা হুয়া…

[ দ্রষ্টব্যঃ বসত করি আম্রিকাতে পাতলু-মটু বাক্যবন্ধের ‘আম্রিকাতে’ শব্দটির স্থলে নিজ দায়িত্বে কানাডাতে/ জার্মানিতে/ ইংল্যান্ডে/ অস্ট্রেলিয়ায়/ সৌদি আরব/ লিবিয়াতে/ ইটালিতে/ মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা যার যার পছন্দের স্থানটি বসাইয়া লইবেন। কারণ ইহা আপনারও ছড়া। স্থানের নাম পাল্টাইবার অধিকার আলবৎ আপনার রহিয়াছে। ]

অটোয়া ২৫ আগস্ট ২০২০

দাসী ম’লে ক্ষতি নাই…চন্দনা মজুমদারের গান এবং ছোটদের কাগজ

লুৎফর রহমান রিটন

আমার স্বভাবই এমন যে কোনো কোনো গান যখন আমাকে পেয়ে বসে, আমিও তখন সেই গানটাকে পেয়ে বসি। গত কিছুদিন ধরে চন্দনা মজুমদারের ‘ভবের ঘাটে’ নামের লালন গীতির সিডিটা আমাকে পেয়ে বসেছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে বেরুনো সিডিটা এখন আমার ড্রাইভিং সময়ের সঙ্গী। এই সিডির বেশ কয়েকটা গান আমার প্রিয় হলেও ইদানিং যেটা পেয়ে বসেছে সেটার প্রথম কলি–আর কতোদিন।

‘আর কত দিন জানি/এ অবলার প্রাণই/

এ জ্বলনে জ্বলবে ওহে দয়েশ্বর/ চিরদিনই…

দুঃখেরই অনলে প্রাণ জ্বলিছে আমার/ চিরদিনই…

দাসী ম’লে ক্ষতি নাই/ যাই হে মরে যাই/

তোমার, দয়াল নামের দোষ রবে রে গোঁসাই/

আমায় দাও হে দুঃখ যদি/

তবু তোমার সাধই

তোমা ভিন্ন দোহার আর দেবো কার/ চিরদিনই…

ও মেঘ হইয়ে উদয়/ লুকালো কোথায়

পিপাসীর প্রাণ যায় পিপাসায়/

আমার কি দোষেরই ফলে

এই দশা ঘটাইলে

চাও হে নাথ ফিরে এখন, চাও হে একবার/ চিরদিনই…

আমি উড়ি হাওয়ার সাথ/ ধরি তোমার হাত

তুমি না তরাইলে কে তরাবে হে নাথ/

আমার ক্ষমো অপরাধো/

দাও হে ঐ শীতল পদ/

লালন বলে প্রাণে সহে না আমার/ চিরদিনই’…

আমি নিশ্চিত এই গানটা চন্দনা ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ এমন দরদ দিয়ে গাইতে পারবেন না। আহা কী দরদীয়া কণ্ঠ এই মানুষটার! শুনি আর মুগ্ধ হই।

যদিও চন্দনার দুর্দান্ত সব লালন গীতি ছাপিয়ে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সিনেমা দর্শকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলো অন্য একটি গান যা তাঁকে আমজনতার কাছে নিয়ে গিয়েছে। চন্দনা এবং কৃষ্ণকলির গাওয়া একটা গান বহুদিন লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ সিনেমার সেই গানটা ছিলো–‘সোনারো পালঙ্কের ঘরে/লিখ রেখেছিলেম দ্বারে/যাও পাখি বলো তারে/ সে যেনো ভোলে না মোরে/ সুখে থেকো ভালো থেকো/মনে রেখো এ আমারে’….।

চন্দনা খুব প্রিয় শিল্পী আমার। যতোবার আমি তাঁকে শুনি ততোবারই তাঁর স্বামী কিরণ চন্দ্র রায়ের নামটি আমার মনে পড়ে এবং যতোবার তাঁর স্বামীর নামটি মনে পড়ে ততোবারই একটা বিব্রতকর ঘটনা আমার চোখের সামনে চলে আসে।

ঘটনাটা বলেই ফেলি আজকে।

আমি তখন ছোটদের কাগজ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করি। পত্রিকাটা খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের শিশুকিশোরদের কাছে। সময়কাল মধ্য নব্বুই। ১৯৯৫ সালের আগস্ট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো ছোটদের কাগজ।  তখন, বছরের পর বছর দিবানিশি একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছি আমি। আমার বন্ধুরা বিপুল বিত্ত বৈভবের পেছনে সময় দিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছিলো আর আমি ছোটদের কাগজ পত্রিকাটির খরচ যোগাতে ক্রমশঃ নিঃশ্ব হচ্ছিলাম। বাংলাদেশে একক প্রচেষ্টায় নিজের টাকায় কোনো এঞ্জিও বা স্পন্সর  প্রতিষ্ঠানের দু’আনা সমর্থন ছাড়াই পত্রিকাটি বেরুতো।

ছোটদের কাগজের একেকটি সংখ্যা বেরুনোর পর প্রেস থেকে ১০০ কপির একটা বড় বান্ডেল আমার বাড়িতে পৌঁছে দিতো পিওন ছেলেটা। আমি সেই একশো কপি কোনো একটি স্কুলে গিয়ে নিজের হাতে কোনো একটি ক্লাশে বিতরণ করে আসতাম। প্রধান শিক্ষক কিংবা প্রিন্সিপল স্যার/মেডামরা আমাকে খুবই সহায়তা করতেন এই কাজে। তাঁরাও থাকতেন আমার সঙ্গে। ক্লাশে যেতে না পারলে রেখে আসতাম তাঁদের কাছে। তাঁরা সেটা বিলি করে দিতেন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। স্কুলে স্কুলে আমার সেই সারপ্রাইজ ভিজিটটা ছেলেমেয়েরা খুব উপভোগ করতো।

তো সেই রকম একটা সময়ে, ১৯৯৯ সালে ছোটদের কাগজের একটা সংখ্যা বেরুলো। ‘ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল ১৯৯৯ সংখ্যা’। প্রচ্ছদে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের একটা পোর্ট্রেইট। ভেতরে ‘ছোটদের বন্ধু দাদাভাই শিরোনামে’ তাঁর বিশাল সাক্ষাৎকার, আমার নেয়া। আমার মেন্টর দাদাভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সেই সংখ্যাটা ছিলো বিশেষ ‘দাদাভাই সংখ্যা’। দাদাভাইয়ের মৃত্যুর পর সেই সংখ্যাটাই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে দাদাভাইয়ের একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জীবনী কাগজগুলো ছাপতে পারে। অধিকাংশ পত্রিকাই ছেপেছিলো দাদাভাইয়ের জীবনী, আমার পত্রিকা থেকেই। রিপোর্টারদের কাজটা সহজ করে দিয়েছিলো ছোটদের কাগজের সেই সংখ্যাটা।

মনে আছে, ১৯৯৯ সালে দাদাভাইয়ের জন্মদিন পালিত হচ্ছিলো সেগুন বাগিচা কচি-কাঁচার মেলার অডিটোরিয়মে। আর সবার মতো আমিও গিয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে, ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে। আমার হাতে ফুলের তোড়া ছাড়াও চকচকে র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা বস্তু ছিলো। উপস্থাপক আমার নামটি ঘোষণা করলেন–এবার দাদাভাইকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে মঞ্চে  আসছেন ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। মঞ্চে উঠে ফুলটা দাদাভাইকে দিয়ে তাঁর হাতে র‍্যাপিং মোড়ানো বস্তুটা তুলে দিয়ে বললাম–এটা খুলে দেখতে হবে দাদাভাই। দাদাভাই বললেন, পরে খুলি? আমি বললাম, না। এখুণি খুলুন দাদাভাই। আমি চাই আমার উপহারটা সবাই দেখুক।

আমার আচরণে খানিকটা বিরক্ত হলেন দাদাভাই। নিতান্ত অনিচ্ছাতেই র‍্যাপিংটা খুললেন তিনি। বেরিয়ে এলো প্রচ্ছদ জুড়ে হাস্যোজ্জ্বল দাদাভাইয়ের মুখ। দর্শকদের দিকে প্রচ্ছদটা ধরে মাইকে আমি বললাম, দাদাভাইয়ের জন্মদিনে এটা আমার পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। সংখ্যাটা আগামীকাল বাজারে যাবে।

বিপুল করতালিতে ফেটে পড়লো পুরো অডিটোরিয়ম।

আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন একটু আগে বিরক্ত হওয়া দাদাভাই।

পরদিন দৈনিক জনকণ্ঠের শেষের পাতায় বিশাল করে ছাপা হলো দাদাভাইয়ের জন্মদিন উদযাপনের সচিত্র প্রতিবেদন। হাসান হাফিজের লেখা সেই প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা হলো না ছোটদের কাগজের পক্ষ থেকে দাদাভাইকে দেয়া অনন্য সেই উপহারটির প্রসঙ্গ!

ছোটদের কাগজ দাদাভাই সংখ্যাটা যখন বাজারে, তখন বাংলা একাডেমির বটতলায়(বর্তমানের নজরুল মঞ্চ) বৈশাখী অনুষ্ঠান চলছিলো। কারণ সেটা ছিলো ইংরেজি এপ্রিল আর বাংলা বৈশাখ মাস। কোনো স্কুলে না গিয়ে দাদাভাই সংখ্যাটার একশো কপি  বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া শিল্পী-আলোচক-লেখক-সাংবাদিক আর দর্শকদের কাছে বিলিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ছোটদের কাগজের সহকারী সম্পাদক, আমার সহকারী খালেদুর রহমান জুয়েল ওর কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে সংখ্যাটা বিতরণ করছিলো। অদূরে দাঁড়িয়ে আমি কথা বলছি একাডেমির কর্মকর্তা বন্ধুদের সঙ্গে।

এক পর্যায়ে জুয়েল সেখানে এসে খুব মন খারাপ করা চেহারা নিয়ে বললো, রিটন ভাই শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়কে ছোটদের কাগজের একটা কপি দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি সেটা ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছি এটার জন্যে কোনো দাম তো দিতে হচ্ছে না। এটা বিনামূল্যে আপনার জন্যে লুৎফর রহমান রিটনের পক্ষ থেকে উপহার। তিনি বলেছেন, এটা তিনি নেবেন না। তখন বলেছি–এটা আপনার ছেলে বা মেয়েকে দেবেন। ওদের জন্যেই তো এই পত্রিকা। তিনি বলেছেন–আমি আমার ছেলেমেয়েকে তো এই পত্রিকা পড়তে দেবো না!

এরকম ঘটনায় জুয়েল খুবই অপমানিত বোধ করছে। সে চাইছে আমি গিয়ে কিছু বলি কিরণচন্দ্রকে। কিন্তু আমি রাজী হলাম না। বললাম, কিরণচন্দ্রের তো পত্রিকাটি নেয়া না নেয়ার অধিকার আছেই।

জুয়েল জিজ্ঞেস করলো–রিটন ভাই আপনার সঙ্গে কি কিরণচন্দ্রের কোনো ঝগড়া হয়েছে?

আমি বললাম, না তো। কোনো ঝগড়া হয়নি তাঁর সঙ্গে। কোনোদিন কোনো তর্কও হয়নি আমাদের, কোনো বিষয়ে।

তাহলে কেনো এমনটা করলেন কিরণ?

হতে পারে আমি তাঁর অপছন্দের মানুষ। হতে পারে দাদাভাই তাঁর অপছন্দের মানুষ। কিংবা হতে পারে ছোটদের কাগজই তাঁর অপছন্দের, কারণ এটার প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হয়। তিনি হয়তো বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন না। হতে পারে তিনি জিয়ার সৈনিক। কতো কিছুই তো হতে পারে!

ওই ঘটনার পরেও আমার সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে কিরণচন্দ্রের। আমি হাসিমুখে তাঁকে হাই-হ্যালো করেছি। কিন্তু একটিবারও জিজ্ঞেস করিনি সেদিন তাঁর সেই আচরণের নেপথ্য কারণটা।

তবে আশার কথা বিব্রতকর সেই ঘটনাটি চন্দনা মজুমদারকে আমার প্রিয় শিল্পী হবার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিরণের নিম তিতা নিশিন্দা তিতা গানটাও বাদ যায়নি আমার শ্রুতির তালিকা থেকে। যদিও জীবনে ওই একটা গানই শুনেছি কিরণের।

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent