শুক্রবার - এপ্রিল ২৬ - ২০২৪

মা আমার কোন নাম রাখেননি

ছবিসৈয়দ ইকবাল

আমার নাম ফেলণী। আমার বাবা আমার এই নামটা রেখেছেন । আমার মা আমার কোন নাম রাখেননি । আমার মা তখন মানসিক ভাবে এতোটা বিপর্যস্ত ছিলেন যে আমার মায়ের কখনো মনেই হয়নি আমার একটা নাম রাখা প্রয়োজন। আমার নাম রেখেছিলো আমার বোনেরা । ওরা ভালোবেসে আমার নাম রেখেছিলো পদ্ম । শিশু ফেলনীকে দেখে তাদের মনে হয়েছিলো আমি একটা গোলাপি পদ্ম ফুল। তাই আমার নাম দেয়া হলো পদ্ম । আমি ফেলনীর জন্য বাবা মা কোন আকিকাও দিলেন না। আমার আকিকা নাকি দিয়েছিলেন আমার নানা নানি।
আমার ফেলনী নামটা কি করে হলো সে গল্পটা আপনাদের একটু বলি?
আমি আমার বাবা মায়ের পঞ্চম সন্তান। আমাদের কোন ভাই নেই । আমার বাবা যেখানে কাজে নিয়োজিত ছিলেন সে স্থানটি শহরের কিছুটা বাইরে ছিলো সিলেট চা বাগানের কাছাকাছি। মা বিয়ের পর সেখানেই সংসার শুরু করেন। বিয়ের ২ বছর পর মায়ের কোল জুরে এলো কন্যা সন্তান আর আমাদের বড় আপু। প্রথম সন্তান বলে বাবা মায়ের আদরের শেষ ছিলো না বড় আপুকে নিয়ে। বাবা মা আদর করে বড় আপুর নাম রাখলেন চম্পাবতী । রাজকন্যাদের নামে নাম। তবে অবশ্য বড় আপু সবার কাছে চম্পা নামেই পরিচিত । শুধু বাবা নাকি আদর করে চম্পাবতী বলে ডাকতেন। বড় আপুর পাঁচ বছর পর্যন্ত বাবা মা সেখানেই ছিলেন। কিন্তু সেখানে কাছে ধারে কোন ভালো স্কুল ছিলো না বলে মাকে বড় আপুকে নিয়ে চলে আসতে হলো শহরের দিকে। শহরে আমাদের নানার বাসার গা ঘেঁসে বাসা ভাড়া করা হলো । আপুকে স্কুলে ভর্তি করা হলো । বাবা সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তার কর্ম স্থলে। আলাদা বাসায় থাকলেও মা আর বড় আপু নানা নানীর দেখাশুনার মাঝেই ছিলেন। বাবা মাসে দু’বার করে আসতেন মা ও বড় আপুর কাছে। বড় আপুর যখন ৭ বছর বয়েস তখন আমাদের মেঝো আপুর জন্ম হলো । বাবা মা আবারো খুশী হলেন দ্বিতীয় কন্যার পিতা মাতা হয়ে। বাবা তার দ্বিতীয় কন্যার নাম রাখলেন লীলাবতী । মা ঘোষণা দিলেন দুই সন্তানই যথেষ্ট । তাদের তাঁরা সুন্দর ভাবে মানুষ করে তুলবেন । বাবা মায়ের কথায় রাজী হলেন না। তার ইচ্ছা একটা পুত্র সন্তান দরকার বুংশের প্রদীপ রক্ষা করার জন্য। বংশের প্রদীপ রক্ষা করার জন্য বাবা মাকে আরো দুইবার গর্ভবতী করলেন এবং মা আবারো দুই কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। চতুর্থ কন্যা জন্মের পর বাবা হিংস্র হয়ে পরলেন। বারবার কন্যা সন্তান জন্ম দেবার জন্য মাকেই দায়ী করতে লাগলেন । মা মানসিক ভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লেন । তৃতীয় কন্যার নাম বাবা রাখলেন ইতিবালা। কারন এখানেই কন্যা সন্তানের ইতি ঘোষণা করলেন। চতুর্থ কন্যার নাম রাখার কোন আগ্রহ বাবার ছিলো না। মা ছোট করে মায়ের চার নাম্বার কন্যার নাম রাখলেন ‘ আশা’। বাবার আচরনে কুৎসিত বাক্যবাণে মা নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করলেন। আর আমাদের মনের দিক দিয়ে অশিক্ষিত বাবা কিছুতেই বুঝলেন না এব্যাপারে মায়ের কোনই হাত নেই।
বাবার মাসে দুবার করে আসা বন্ধ হলো । বাবা প্রতি তিন মাসে একবার করে এসে থেকে যান । বাবা আসলে মা ভয়ে মুষড়ে থাকতেন, ভাবতেন আবার যদি কিছু হয়ে যায় । এটা সেটা অজুহাত দিয়ে মা বোনদের সাথে থাকতে চাইতেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মা বুঝতে পারলেন তার দেহে আরেকটি প্রান জেগে উঠেছে । মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বাবাকে কিছুই না জানিয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলেন মা এই প্রান যেনো পৃথিবীতে না আসে সে চেষ্টাতে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি আমাকে পৃথিবীর মুখ দেখাবেনই । তাই মার আপ্রান চেষ্টাতেও আমার শক্ত প্রাণটা রয়ে গেলো মায়ের দেহে। মা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন বাবার ভয়ে। মায়ের রক্তচাপ বেড়ে গেলো , সারাদিন বিছানাতে শুয়ে থাকেন মা। আমাদের সংসারের সমস্থ কাজের ভার নানী কাঁধে নিয়ে নিলেন। বাবা মাকে শাসিয়ে গেলেন এবার মেয়ে হলে বাবা মাকে তালাক দেবেন এবং আরেকটি বিয়ে করবেন। অবশেষে এক গভীর রাতে আমি নিষ্ঠুর পৃথিবীর আলো দেখলাম। আমার জন্মের খবরে মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি বাবা মায়ের অবাঞ্ছিত সন্তান। তাই মা আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। বাবা খবর পেয়েও আমাকে বা মাকে দেখতে এলেন না। ছয় মাস পরে বাবা এলেন কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। নানী আমাকে নিয়ে বাবার কোলে দিতে চাইলেন , বাবা হাত বাড়ালেন না, মুখ ঘুড়িয়ে রাখলেন। আমার জন্মের জন্য সচাইতে বড় আসামী আমি ছো্ট শিশুটি হয়ে গেলাম। বাবা আমার নাম রেখে গেলেন ফেলনী ।
মা সারা বছর নানা কারনে অসুস্থ থাকেন। বাবা বছরে একবার আসেন । জানাজানি হয়েছে বাবা অত্যান্ত নিম্নশ্রেনীর একজন চা বাগানের কুলির তরুণী মেয়েকে বিয়ে করেছেন পুত্রসন্তান লাভের আশায়। আমি বড় হতে লাগলাম আমার বড় দুই বোন ও নানীর আদর ভালোবাসাতে । মা বাবার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখেনি। ধীরে ধীরে বাবার বাড়িতে আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো । তবে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন সংসারে । আমি এখন বড় হয়েছি এবার কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার বড় আপুই আমার মা। আমার দেখাশুনা সমস্ত ব্যয়ভার বড় আপুই বহন করেন। বড় আপু এবং বড় আপুর বর দুজনই ডাক্তার । মেঝো আপুও ভালো চাকুরী করে সেও ভালো আছে তার ঘর সংসার, কাজকর্ম নিয়ে। ইতিবালা আর আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে । আর আমি ফেলনী মায়ের অবহেলিত বাবার অবাঞ্ছিত কন্যা সন্তান হয়েই থাকলাম। আমি বুঝতে পারতাম মা আমাকে তেমন ভালোবাসেন না ।মায়ের হয়তো ধারনা হয়েছিলো আমার জন্যই মায়ের সংসার ভেঙেছে , বাবা আবার বিয়ে করেছে। কিন্তু আমার চার বোনের আটটি হাত আমাকে ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ ।
আপনারা তো আমার ফেলনী হওয়ার গল্প শুনলেন। এখন আপনারাই বলুন আমার জন্মের জন্য কি আমি দায়ী ছিলাম নাকি আমার বাবা মা? আমিতো পৃথিবীতে আসতে চাইনি। তবে কেনো আমি বাবা মায়ের অবহেলিত অবাঞ্ছিত সন্তান হয়ে বেঁচে রয়েছি?

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent