শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

চীনের গ্রেট ওয়ালে কিছুটা সময়

১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝির দিকের ঘটনা। বেইজিং এ যাচ্ছিলাম একটি কনফারেন্সে অংশ নেওয়ার জন্য। থাই এয়ারলাইনস্‌ এর প্লেন ল্যান্ড করার কয়েক মিনিট আগে কক্‌পিট থেকে ঘোষণাতে জানালো, বেইজিং এর তাপমাত্রা জিরোর অনেক নিচে নেমে গেছে। বরফে ঢেকে গেছে পুরো বেইজিং শহর। দুশ্চিন্তা এবং দুঃখ মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। প্রথমত, আমরা কেউ শীতের কাপড় নিইনি সাথে কারণ বছরের এই সময় বরফ পড়ার কথা নয় কোনভাবেই। আমাদের সেভাবেই ড্রেস-কোড্‌ দেয়া হয়েছিলো। দ্বিতীয়ত, মনের মধ্যে একটি তীব্র ইচ্ছে ছিল চায়নার গ্রেট ওয়ালে ওঠার, সেই সুযোগটাও হয়ত হারালাম। কয়েকটি দেশ থেকে আগত আমরা বেশ কিছু পারটিসিপ্যান্ট ছিলাম। সকলেরই একই অবস্থা। এয়ারপোর্ট থেকে মাইক্রোবাসে করে হোটেলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল। পৌঁছেই সবাই গরম কাপড়ের সন্ধান করতে শুরু করলেন। কনফারেন্সের কাজ চলতে থাকল। কেউ তেমন বের হলো না। বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং তাঁর স্ত্রী আমাদের গরম কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করলেন এবং সেই সাথে আরও অনেক ধরণের সহযোগিতা করেছিলেন তাঁরা। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের। বরফে ঢাকা ওয়ালে ওঠার প্রস্তুতি হিসেবে বিশেষ ধরণের জু্তো কিনতে হল যাতে বরফে পা পিছলে না যায়।
কনফারেন্সের শেষ দিনে এক তরুণ চাইনিজ এসে জানতে চাইল আমরা কে কে গ্রেট ওয়ালে উঠতে আগ্রহী। আমাদের ডিরেক্টর এবং আমি রাজি হয়ে গেলাম। সাথে কয়েকজন বিদেশী। সবাইকে মোটামুটি ধারণা দেওয়া হল কেবল্‌-কারে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকবে। সেই সাথে গ্রেট ওয়ালে ওঠার ব্যবস্থাও থাকবে। সেখানেই আমরা গ্রেট ওয়াল দেখার সুযোগ পাবো। বরফ এবং ঠান্ডার কারণে সিঁড়ি ভেঙ্গে কেউ আর উপড়ে উঠতে চাইছে না, ভাবছেও না ওঠার কথা। গাড়িতে বেইজিং এর কোনো একটি স্পটে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রেট ওয়াল দেখার জন্য। জায়গাটার নাম মনে নেই এখন। একটি কেবল্‌-কারে করে আমাদের এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। নিচে গ্রেট ওয়াল দেখতে পেলাম। ওয়ালের একটি চৌকিতে যেয়ে কেবল্‌-কার থামল। ভারী শীতের কোট পরা। তার উপরে ওখান থেকে গ্রেট ওয়ালের সিম্বলসহ বেশ কিছু সুভেনির কিনে নিজেকে আরও ভারী করে ফেললাম। কারণ আমার ধারণা হয়েছিলো আমরা আর সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠছি না। এরই মধ্যে আমাদের চাইনিজ গাইড এসে জানালো যারা উপরে উঠতে চান তারা তার সাথে যেতে পারেন। সিঁড়িতে বরফ থাকা সত্ত্বেও আশেপাশে কেউ কেউ উপরে উঠছে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে, আমি হাত তুললাম। আমার ডিরেক্টরের হার্টে বাইপাস করা। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আগ্রহী ব্যক্তি একমাত্র আমি। গাইড আমাকে বোঝালো, যতটুকু আমি উঠতে পারি উঠব। না পারলে কেবল্‌-কার দিয়ে নিচে নেমে যাবো।
শুরু হল আমাদের যাত্রা। আমার পিছনে চাইনিজ গাইড। মানুষের পায়ে পায়ে সিঁড়ির উপরের বরফ জমে শক্ত হয়ে গেছে। পা পিছলে যাচ্ছে বার বার। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রড চলে গেছে ধরার জন্য এবং সেটাই একমাত্র ভরষা। ওটা ধরেই উঠছি আমরা। কিছুদুর যাবার পর পিছনে গাইডের দিকে ফিরে তাকালাম। চোখে মুখে অনিচ্ছা আমার। তাপমাত্রা মাইনাস -১৫ এবং তার সাথে বাতাস। সিঁড়িতে বরফ থাকার কারণে এগোনো যাচ্ছিল না। আমার গাইড আমাকে জানালো একবার কোনভাবে উপরে উঠতে পারলে আমরা কেবল্‌-কার পাবো নামার জন্য। তাই নামার সময় কষ্ট হবে না। গাইড ছেলেটির প্রচুর আগ্রহ দেখে আর তেমন না করতে পারলাম না। ভাবলাম, কেবল্-কার তো পাবোই নামার জন্য। পা পিছলে যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে ভয়, নিচে গড়িয়ে পড়ার। তারপরও উঠছি। সিঁড়িগুলো বেশ চওড়া। পাশাপাশি প্রায় ১৫ জন মানুষ একসাথে উঠতে পারবে।
সিঁড়ির দুই পাশের দেয়ালে ক্যাসেলের মত কেটে ফাঁকা করা। সম্ভবত যুদ্ধের কৌশল হিসেবে করা হয়েছে এভাবে। সেখান থেকে পাহাড়ের নিচের অংশ দেখা যাচ্ছে। সিঁড়িগুলো বেশ মজবুত মনে হল। কোথাও ভাঙাচোরা পেলাম না। এত আগের স্থাপনা অথচ এত সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে দেখে অবাক হলাম। পরে শুনেছিলাম ওরা বিশেষ কিছু স্থানে মেরামত করেছেন ভিজিটরদের সুবিধার জন্য।
চীনের মহাপ্রাচীর বা The Great Wall of China মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছে ৭ম আশ্চর্যের তালিকায়। পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি সুদীর্ঘ প্রাচীরের সারি। এই প্রাচীর প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু এবং আনুমানিক ৮৮৫২ কিলোমিটার লম্বা (বিভিন্ন তথ্যে বিভিন্ন মাপ দেয়া আছে)। এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস থেকে এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামের একটি স্থানে। প্রশ্ন হতেই পারে, এই রকম একটা বিকট আকৃতির প্রাচীর তৈরি করার প্রয়োজন কেন হয়েছিল তাদের? ২৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীন বিভক্ত ছিল খণ্ড খণ্ড রাজ্যে আর প্রদেশে। এদের মধ্যে একজন রাজা ছিলেন, যার নাম ছিল শি হুয়াঙ। তিনি অন্যান্য রাজাদের সংঘবদ্ধ করে নিজে সম্রাট হন। চীনের উত্তরে গোবি মরুভূমির পূর্বে দুর্ধর্ষ মঙ্গলদের বাস, যাদের কাজই ছিলো লুটতরাজ করা। এই মঙ্গলদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য সম্রাটের আদেশে চীনের প্রাচীর তৈরির কাজ আরম্ভ হয়। এরকম অনেকগুলি প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, তবে ২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট শি হুয়াঙের অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই সবচেয়ে বিখ্যাত।
জানতে ইচ্ছে করে, সম্রাটের উদ্দেশ্য কি সিদ্ধ হয়েছিল? মঙ্গল দস্যুরা দেয়াল ভেঙে ফেলে চীনের মূল ভূখণ্ডে লুটপাট করার জন্য ঢুকে পড়ত। বর্তমানে টিকে থাকা প্রাচীর চীনের ঐতিহ্য বলে রক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও প্রাচীরের অনেক জায়গা এখনও কিছু কিছু ভাঙা স্থান রয়েছে। এর মূল অংশের নির্মাণ শুরু হয়েছিল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ সালের দিকে। চীনের প্রথম সম্রাট কিং শি হুয়াঙ এটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে চীনের প্রাচীরের পরিবর্ধন, পরিবর্তন, সম্প্রসারণ ও পুনঃনির্মাণের উল্লেখ আছে। বিভিন্ন সময়ের শাসকরা এই প্রাচীর নির্মাণ অব্যাহত রাখেন। প্রাচীরটিতে নিয়মিত বিরতিতে পর্যবেক্ষণ চৌকি আছে। চৌকিগুলো অস্ত্র সংরক্ষণ, সেনাবাহিনীর আবাসন এবং শত্রু দেখে স্মোক সংকেত প্রদানের কাজে লাগত। গ্রেট ওয়ালের সীমানার মধ্যে সেনা ইউনিটগুলোর যোগাযোগ যেমন দলকে শক্তিশালী করা এবং শত্রুদের আন্দোলন সম্পর্কে সাবধান থাকা ছিল উল্লেখযোগ্য। দেখার সুবিধার জন্য পাহাড়সহ অন্যান্য উঁচুস্থানে সংকেত-টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত একসময় উপরে উঠতে পারলাম। উপরে উঠেই ধপাস করে বসে পড়েছি। অবাক হয়ে ভাবছিলাম কিভাবে শ্রমিকরা পাহাড়ের এত উপরে বড় বড় পাথরের টুকরা এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী টেনে তুলেছিলো? খুব কষ্ট হচ্ছিল তাদের কথা ভেবে। আমার গাইড তখন বার বার চিৎকার করে বলছে, We are on the top !! অদ্ভুত এক ধরণের অনুভূতি কাজ করছিল। ঠান্ডায় ক্যামেরার ব্যাটারী কাজ করছিলো না। নিজের মনকে শান্তনা দিচ্ছিলাম, ফেরার পথে কেবল্‌-কার পাচ্ছি। চাইনিজ গাইড কেবল্‌-কার এর খোঁজে গেলো। কিছুক্ষণ পরে আমার চাইনিজ গাইড চোখে-মুখে হতাশা নিয়ে ফিরে এলো। জানালো, সে ভুল জেনেছিল, এখান থেকে নেমে যাবার জন্য কোন কেবল্‌-কার নেই, আমাদের সিঁড়ি বেয়েই নামতে হবে। সেইদিন প্রথম বুঝলাম, ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বরফে ঢাকা সিঁড়ি বেয়ে নামাটা কতখানি কষ্টের এবং বিপজ্জনক। তাপমাত্রা দ্রুত নেমে যাওয়াতে এবং ঝড়ের সম্ভাবনা থাকাতে ওখানে তখন মাইকে ঘোষণায় সবাইকে নিচে নেমে যাবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিল। জানানো হচ্ছিল, সিঁড়িতে থাকা বিপজ্জনক এবং সিঁড়ির প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হবে অচিরেই। সেদিন কিভাবে নেমে এসেছিলাম, আজ তা মনে করতেও ভয় লাগে। নিচে নেমে দেখলাম দলের বাকিরা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। গাইড ছেলেটি তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে সবাইকে চিৎকার করে বলছে, “She has been on the top of the wall. She won the wall ! She is a man !” আমাকে ‘ম্যান’ বলাতে হাসছিলো সবাই। আমাকে ওয়ালের টপে ওঠাতে পেরে তার নির্মল আনন্দ উচ্ছ্বাসের প্রকাশটুকু ভালো লাগছিল। ভুলিনি তাকে আজও।
ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত

- Advertisement -

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent