বৃহস্পতিবার - মার্চ ২৮ - ২০২৪

আদি বাঁধ কাত্তিনাহ


প্রকৌশল বিদ্যা আবিষ্কারের আগেই মানুষ বাঁধ নির্মাণ করতে শিখেছিলো। গাণিতিক হিসাব কষে নয়, বরং প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে তাল রেখে বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি অনুমান করে মাটির বেড়া বানিয়ে বাঁধ দিতো। পানি তরল পদার্থ। তাই একে বেড়া দিতে হলে ছিদ্রবিহীন উঁচু বেড়া বা দেয়াল প্রয়োজন। মানুষ সর্বপ্রথম কাঁদা দিয়ে বেড়া বানিয়ে পানি আটকাতে সমর্থ হয়। কাঁদামাটি একের পর এক স্তর বানিয়ে উঁচু করে সাজালে বাঁধের সৃষ্টি হয়। আবার বেলে মাটিতে তা করা যায়না। বেলেমাটির কণায় একের সাথে অপরের সাথে আকর্ষণ নেই। অথচ কাঁদামাটির প্রতিটি কণা একে অপরের সাথে আটকে থাকে। বুদ্ধিমান মানুষ তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিলো সব মাটির মেকানিজম এক রকম নয়। মাটির সব কণায় এক রকম এডহেসিভ ফোর্স কাজ করেনা। সয়েল মেকানিক্স কিংবা জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আবিষ্কারের পেছনে মূলত এই দর্শনগুলো কাজ করেছে। তবে সকল প্রকার ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা বাজারে আসার আগেই মানুষ অনুমানের উপর নির্ভর করে ছিদ্রবিহীন জলচাপ সহনীয় মাটির বাঁধ বানিয়ে নদীর বান ঠেকিয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পাশ্চাত্যের অবদান অন্য মহাদেশের তুলনায় বেশি। পানিসম্পদ প্রকৌশলেও ইউরোপ ও আমেরিকা অন্যদের থেকে এগিয়ে। বিশেষ করে ইউরোপে নেদারল্যান্ড, জার্মানি, স্পেন, ইতালি আর উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে পানিসম্পদ গবেষণা এবং এর প্রকৌশলগত প্রয়োগ অনেক বেশি। যদিও প্রয়োগের দিক থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি গেলো ৪০ বছরে অনেক এগিয়েছে। তবে প্রাচীনকালে পানি সম্পদ নিয়ন্ত্রণে প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রেখেছিলো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রো-আরবদেশ গুলো।
বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস মানেই মেসোপটেমিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যে জলনিয়ন্ত্রনের ইতিহাস। দজলা আর ফোরাত নদীকে বাগে আনতে প্রাচীনকালে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট করেছে। ইতিহাস ঘটলে দেখা যায় মানুষ প্রথম বাঁধ বানিয়েছিলো বর্তমান রাষ্ট্র জর্ডানে। রাজধানী আম্মান থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরপূর্ব দিকে জাওয়া নামক স্থানে। খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর। ৩০ ফুট উঁচু ছিল এ বাঁধ। মিশরীয়রা বাঁধ বানিয়েছিলো খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে। কায়রো নগরীর মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে ছিলো এই বাঁধ।
প্রকৌশল অবকাঠামোর বিশ্বস্বীকৃত বিস্ময়কর নিদর্শনের একটি ইয়েমেনের গ্রেট ড্যাম অব মাড়িব। খ্রিস্ট পূর্ব সাড়ে সতেরো থেকে সতেরো শ’ (১৭৫০ ~ ১৭০০) বছর আগের কথা। কাঁদামাটির বাঁধ বানিয়েছিলো আরবরা। ত্রিভুজাকৃতির ক্রসসেকশন। যদিও জ্যামিতির একাডেমিক বিকাশ ঘটেনি তখন। ৫৮০ মিটার লম্বা বাঁধটির উচ্চতা ছিলো ৪ মিটার না ১৩ ফুট। কাঁদামাটির ভেতর পাথর আটকানো হয়েছিলো বাঁধের লম্বালম্বি দুপাশে। সেচ কাজের জন্য মাড়িব বাঁধ বানানো হয়েছিলো। তাই বাঁধ রক্ষায় রাজা মহারাজারা সেসময় লক্ষ লক্ষ অর্থমুদ্রা ব্যয় করেছে। বেশ কয়েকবার মাড়িব বাঁধ মেরামত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ বছর আগে বাধঁটিকে ৭ মিটার বা ২৩ ফুট উঁচু করা হয়। সাবা সাম্রাজ্যের আমলে কাজগুলো করা হয়েছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ বছর আগে সাবা সাম্রাজ্যের পতন হলে হোমরাইট বা হিম্যারিত শাসন আমল শুরু হয়। এ সময়কালেও বাঁধের রক্ষনাবেক্ষন এবং উন্নয়ন কাজ চলতে থাকে। হোমরাইট শাসকেরা বাঁধের ডিজাইন পরিবর্তন করে ১৪ মিটার বা ৪৬ ফুট উঁচু করে। যাতে আরও বেশি পানি শুষ্ক মরশুমের জন্য ধরে রাখা যায়। জলনিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচটি স্পিলওয়ে এবং দুটি স্লইস গেট বানানো হয়। গেট দুটি রিইনফোর্সড ইটের তৈরী। খ্রিস্ট জন্মের ৩২৫ বছর পরে পর্যন্ত এর উন্নয়ন কাজ চলছিলো। বাঁধ থেকে পানি সরিয়ে নেয়ার জন্য ১ কিলোমিটার দৈর্ঘের সরবরাহ খাল বা ক্যানেল খনন করা হয়েছিল। উঁচু বাঁধের অতিরিক্ত জল থেকে ২৫ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া হয়েছিলো। ওই যুগে সেটি ছিল শ্রেষ্ঠ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে নিচের উচ্চতায় অবস্থান করে ওলন্দাজ জাতি অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই বাঁধ নির্মাণে হাত দেয়। তাই ডাচ বা ওলন্দাজ জাতি তাঁদের দেশ নেদারল্যান্ড রক্ষার জন্য মধ্যযুগ থেকেই পানিসম্পদ গবেষণা চালিয়ে আসছে। ব্রোঞ্জযুগ বা তারও আগে থেকে ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতে তাঁরা দেশ রক্ষায় বাঁধ বানিয়েছে। পানিসম্পদ প্রকৌশলী দেশটি বিশ্বে শীর্ষ স্থানীয়। দেশটির রাজধানী আমস্টার্ডামের গোড়া পত্তন হয়েছিলো আমস্টেল নদীর উপর বাঁধ দিয়ে। দ্বাদশ শতকে এ বাঁধ নির্মিত হয়েছিলো। নেদারল্যান্ডের আরেক বিখ্যাত শহর রটারড্যাম শুরু হয়েছিলো রট্টে নামক নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে।
খ্রিস্টপূর্ব বাঁধগুলির তেমন অস্তিত্ব নেই। জল আটকানো কিংবা সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু আগে থেকে। এরই মাঝে কিছু বাঁধ এখনো মানব সভ্যতাকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বয়সের দিক থেকে প্রাচীন কিন্তু এখনো জলসেবায় নিয়োজিত এমন বাঁধের ভেতর সবচে প্রবীণ কাত্তিনাহ বাঁধ। মিশরের ফেরাউন সাম্রাজ্যের রাজা মেনমাত্রি সেঠি খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ১৩ শত বছর আগে সিরিয়ায় এ বাঁধের কথা ভেবেছিলেন। তবে বাঁধ নির্মাণ তখন হয়নি। নির্মাণ হতে পেরিয়ে গেছে আরো দেড় হাজার বছর। খ্রীষ্টের জন্মের ২৮৪ বছর পর বাঁধের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে ফেরাউন জগ শেষ হয়ে গেছে বেশ আগেই। রোমান সাম্রাজ্যের জয়জয়কার। রোমানরা কাত্তিনাহ বাঁধের কাজ শুরু করে রোমান প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। সিরিয়ার হোমস শহরের কাছে ছোট এ বাঁধের আরেক নাম লেক হোমস ড্যাম। আসলে এই লেকের নাম কাত্তিনাহ। সিরিয়া লেবানন বর্ডার সংলগ্ন কাত্তিনাহ লেক আকারে খুব বড় নয়। লেকের পুব প্রান্তে বাঁধ তৈরী শেষ হয় খ্রিষ্ট জন্মের ৩০৫ বছর পর।
রোম সম্রাট ডিওক্লেটিয়ান কাত্তিনাহ বাঁধ নির্মাণ করেন। ২ কিলোমিটার লম্বা বাঁধ। উচ্চতা ৭ মিটার বা ২৩ ফুট। এটি ইটের তৈরী গ্রাভিটি ড্যাম। ইটগুলি আবার ব্যাসল্ট ব্লক। ব্যাসল্ট হলো কম সান্দ্রতা (লো ভিসকোসিটি) সম্পন্ন ম্যাগনেসিয়াম এবং আয়রনযুক্ত আগ্নেয় লাভা যা দ্রুত ঠান্ডা হয়ে এক রকম পাথরে পরিণত হয়। সেই পাথর কেটে ইটের ন্যায় ব্যাসল্ট ব্লক তৈরী করা হয়। সেই যুগে রোমানদের তৈরী হাইড্রোলিক সেটিং সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিলো। পোজোলনিক অ্যাশ দিয়ে এ সিমেন্ট তাঁরা এ সিমেন্ট বানায়। ব্যাসল্ট ব্লক এবং পোজোলনিক অ্যাশের মর্টার এবং কংক্রিট সমন্বয়ে কাত্তিনাহ বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। এটি গ্রাভিটি ড্যাম অর্থাৎ ইটের ভর ব্যবহার করে বানালেও একটি অংশে কার্ভেচার বা বাঁক তরী করে আর্ক-ড্যাম করা হয়েছে। যেখানে ইটের ভর বা লোড সরাসরি নীচে না নেমে পাশের ব্লকটিকে চাপ দিয়ে ধরে আছে। এভাবে পরপর কয়েকটি ব্যাসল্ট ইটের ব্লক একে অপরকে আটকে রেখে লম্বা ওয়াল তৈরী করেছে। ভগ্ন জর্জরিত হলেও আদিকালের বাঁধটি আজো চালু অবস্থায় রয়েছে।

ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent