বৃহস্পতিবার - এপ্রিল ২৫ - ২০২৪

ক্যানসার গবেষণায় সফল অস্ট্রেলিয়ার ব্লাশউড বেরি

অস্ট্রেলিয়ার একটি নির্দিষ্ট এলাকার আদিবাসীরা স্থানীয় ব্লাশউড গাছ এবং বেরিকে জানতেন শত শত বছর ধরে। এই বেরির দ্রুত রোগ নিরাময়ের ক্ষমতার কারণে এটি আদিবাসী এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে খুব সমাদৃত ছিল। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয় বিজ্ঞানীরা এমনই এক জাতের বেরি আবিষ্কার করেছেন যার ভিতরে অদ্ভুত শক্তিশালী একটি ক্যানসার প্রতিরোধী কম্পাউন্ড রয়েছে। এই কম্পাউন্ড থেকে তৈরি হয়েছে ক্যানসার বিরোধী একটি ওষুধ EBC-46। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্যানসার সেলকে ধ্বংস করতে সক্ষম ব্লাশউড বেরি থেকে তৈরি এই করা ওষুধ। এই বেরিতে যে কম্পাউন্ড থাকে তা আক্রান্ত টিসুতে রক্তের গতিকে কন্ট্রোল করে এবং রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে স্টিমুলেট করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই ড্রাগটি ৩০০ পশুর উপরে পরীক্ষা করা হয় যার মধ্যে রয়েছে বিড়াল, ইদুর, কুকুর, ঘোড়া এবং Tasmanian devils। এই সমস্ত প্রাণীরা বিভিন্ন ধরণের সুপারফিসিয়াল ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে আক্রান্ত ছিল। প্রাণী এবং মানুষের উপর পরীক্ষা করে ৭৫% ক্যানসার নির্মূল করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের গবেষণায় তাঁরা জানতে পেরেছেন যে এই বিশেষ বেরি, মুখমন্ডল, ঘাড়, মাথা, প্রস্টেট, ব্রেস্ট এবং ত্বকের গুরুতর ক্যানসার এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। বিশিস্ট বিজ্ঞানী ডঃ গ্লেন বইল (Dr. Glen Boyle) এবং তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী অনেক বছরব্যাপী এই গবেষণা কাজ শেষ করেছেন ক্যানসার প্রতিরোধী এই বেরির কার্যকারিতা নিয়ে। গবেষণাটি সংঘটিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেনে, QIMR বারগোফার মেডিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটে।
ABC নিউজের তথ্য অনুযায়ী এই সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে ৭৫% ভাগ প্রাণীর ক্যানসার সম্পূর্ণ ভাবে নির্মূল করা গেছে এই ওষুধ প্রয়োগ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি মাত্র ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করার পর চার ঘন্টার মধ্যেই টিউমারের ক্যানসার সেলগুলোর ভায়াবিলিটি নষ্ট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত টিউমারটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে এবং এই সব টিউমার আর কখনো ফিরে আসেনি। বিজ্ঞানীদের মতে এই বেরির বীজে এক ধরণের কম্পাউন্ড পাওয়া যায় যা পিউরিফাই করা বেশ কঠিন এবং জটিল ব্যাপার। ডঃ গ্লেন বইল জানান এই কম্পাউন্ডটি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে কাজ করে। ১) এটি টিউমারকে সরাসরি মেরে ফেলে ২) এটি টিউমারে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ৩) আক্রান্ত পশুর শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে একটিভেট করে এবং রক্তের এবং শরীরের দুষিত পদার্থকে পিউরিফাই করে।
এই ড্রাগের একটি বড় প্লাস পয়েন্ট হল এটা ক্যানসার রোগীর জন্য নিরাপদে ব্যবহার করা হচ্ছে কারণ এই ওষুধের কোন সাইড এফেক্ট নেই। যেটা ক্যানসারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বেশিরভাগ ওষুধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন মানুষের শরীরের জন্য বেশ টক্সিক এবং খুব বাজেভাবে সাইড এফেক্ট আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে দুর্বল করে ফেলে। আরও বেশি ভাল খবর হল এটা খুব দ্রুত কাজ করে ক্যানসারের বিরুদ্ধে। ABC নিউজের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে এই ড্রাগ যখন টিউমারের মধ্যে ইনজেক্ট করা হচ্ছে, এটা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কাজ করতে শুরু করে দিচ্ছে। পুরো টিউমারটি মিলিয়ে যেতে মাত্র ১৫ দিন সময় লাগছে। অবশেষে টিউমারটি স্কিন থেকে খুলে পড়ছে বা বলা যায় ঝড়ে পড়ছে। এবং আরও ভাল খবর যেটি তা হল টিউমারটি আর ফিরে আসছে না। বাজারে চালু হওয়া ড্রাগগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগে যাচ্ছে টিউমার ধ্বংস হতে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টিউমারটি আবার ফেরত আসার সম্ভাবনা থাকছে।
এই ফল বা বেরির বৈজ্ঞানিক নাম Hylandia dockrillii। এই গাছ Euphorbiaceae পরিবারের অন্ত্রভুক্ত এবং Hylandia জেনাসের একমাত্র প্রজাতি। এই জেনাসের নামকরণ করা হয় বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী Bernie Hyland এর নাম অনুসারে। ব্লাশউড (Blushwood) গাছ এক ধরণের শ্রাব (shrub) বা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছ পৃথিবীর ছোট্ট একটি অংশে জন্মায়, কুইন্সল্যানডের ফার নর্থ এলাকাতে কুক নামের একটি স্থানে। এই ছোট্ট এলাকাটির রেইন ফরেস্টে এই গাছটি জন্মায় এবং এই গাছটি তার বৃদ্ধির ব্যাপারে বেশ স্পর্শকাতর। সুনির্দিষ্ট একটি পরিবেশ না পেলে ব্লাশউড গাছ বড় হয় না এবং ফল তৈরি করে না। বিজ্ঞানী ডঃ বইল বলেন, “মানুষ চেষ্টা করছে ব্লাশউডকে আরও বিভিন্ন পরিবেশে জন্মানোর জন্য এবং এই গাছের ফার্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাজটা কঠিন মনে হচ্ছে।” ব্লাশউডের ব্যবহারের উপযোগিতা দেখে এই কাজের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা ভাবছেন তাদেরকে গ্রীনহাউস কন্ডিশনে জন্মানো যাবে কিনা যাতে সারা পৃথিবীর মানুষ এই গাছটির ক্যানসার উৎপাদন কম্পাউন্ড ব্যবহার করে উপকার পেতে পারেন।
সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ডঃ বইল এবং তার টিম যথেষ্ট পরিমান EBC-46 ড্রাগ তৈরি করতে পেরেছেন মানুষের শরীরে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য। মানুষের উপর প্রয়োগ করার অনুমতিও পেয়ে গেছেন তাঁরা। সমস্যা হল এই ড্রাগটি সব ধরণের ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। কেবল মাত্র চোখে দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ ত্বক অথবা অন্যান্য অঙ্গের উপরে হয়েছে এমন ক্যানসারের জন্যেই ব্যবহার করে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। ত্বক, মাথা, ঘাড়, ব্রেস্ট, প্রস্টেট এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসার এর ক্ষেত্রে এটি কাজ করছে। ইন্টারনাল ক্যানসারের উপর এই ওষুধ ব্যবহার করে এখনো তেমন স্বার্থকতা পাওয়া যায়নি। যেমন, এই ওষুধ metastatic cancers অর্থাৎ যে ক্যানসার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে তার ক্ষেত্রে এখনও কার্যকরী হয়নি।
গত ২১ শে আগস্ট, ২০১৬ তে একটি জার্নালে প্রকাশিত ইনফর্মেশন অনুযায়ী জানা যায় যে EBC-46 ড্রাগটি সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে মানুষের উপর। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানের আটজন ক্যানসার রোগীর জন্য EBC-46 ব্যবহার করা হয়েছে। যা খুব সার্থক ভাবে চার ধরণের টিউমারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন – মেলানমা (melanoma),স্কুয়ামাস সেল কার্সিনোমা (squamous cell carcinoma),ব্যাসাল সেল কার্সিনোমা (basal cell carcinoma) এবং ব্রেস্ট অ্যাডিনোকার্সিনোমা (breast adenocarcinoma)।
ডেনিস পাওয়েল নামে একজন ক্যানসার রোগী জানান (যিনি ট্রায়ালে ছিলেন) এই চিকিৎসা পদ্ধতি তাঁর বাহুর নিচের টিউমারের উপর দ্রুত কার্যকর হয়েছে। ডেনিস খুবই অবাক হয়ে গেছেন EBC-46 ইঞ্জেকশনটির কার্যকারিতা দেখে। “মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে টিউমারটি কালচে বেগুনী রঙ ধারণ করে এবং দুই দিনের মধ্যে শ্রিঙ্ক করে ছোট হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়। EBC-46 মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ট্রিগার করছে এবং হোয়াইট ব্লাড সেল টিউমারকে ধ্বংস করতে পারছে। QBiotics CEO ডঃ ভিকটোরিয়া গরডন জানান যে ব্রিসবেন, সিডনী, মেলবোর্ন এবং এডেলেইড হসপিটালে যাদেরকে এই ওষুধটি দিয়ে ট্রায়াল দেয়া হয় তাঁদের কারুর ক্ষেত্রেই ওষুধ থেকে কোন সাইড এফেক্ট পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, “আমাদের শেষ মেলানোমা পেশেন্টের দুটো টিউমারই ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। আমরা এই চিকিৎসার ফলাফল নিয়ে খুবই খুশী এবং আশান্বিত”। মাত্র সাত দিনের মধ্যেই তার টিউমার চলে গেছে। সবচাইতে আশাব্যাঞ্জক খবর হল এই ওষুধটি বিড়াল, কুকুর এবং ঘোড়ার টিউমারের ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করেছে ঠিক একই ভাবে কাজ করেছে মানুষের বেলাতেও। এটা প্রমাণ করছে যে ওষুধটি নির্দিষ্টভাবে কোন স্পিশিজের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা একটা ব্যাপক রেঞ্জ এর টিউমারের উপর কাজ করছে। ওষুধটি আরও অধিক সংখক মানুষের উপর ট্রায়াল দেবার পর কমার্শিয়াল প্রডাকশনের জন্য যাবে এবং অস্ট্রেলিয় বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে আগামীতে এই ওষুধটি মানুষের শরীরে ব্যবহার করার জন্য কমার্শিয়ালি পাওয়া যাবে।

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent