শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

আসা যাওয়ার পথের ধারে

ছবিইভারটন ভিলা

গোধূলীর ম্লান আলোয় জিনিয়া মেলে দেয় সব আগল, খুলে দেয় হাট করে কপাট। গভীর গোপনে জমিয়ে রাখা কষ্ট, অভিমান নদীর প্লাবন ভাষা স্রোতের মতন বয়ে চলে। শুরু থেকে বলে যায় জিনিয়া দেশের বীরত্ব, গৌড়ব মাখা ইতিহাসের সাথে জড়িত ওর জীবন বদলের দুর্বিষহ বেদনার কাহিনী। উজান স্রোতে টালমাটাল হাবুডুবু খায় তাতাই আর তিতাস।
আপেক্ষা আর ভালোলাগায় উদাস হতো মাজহারের জন্য। বিকাল হতেই চা বানিয়ে সেজেগুজে অপেক্ষা করত কখন আসবে। প্রতিদিনই দেরি হয়ে যেত ওর অফিস থেকে ফিরতে। প্রতিদিন একটা না একটা অজুহাত, আজ বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছিল উনার কাজ করে দিতে হলো। আজ বাইরে যেতে হয়েছিল অফিসের কাজে, বাহানার শেষ ছিল না। বিকালের আলো ম্লাান হতে হতে সূর্যের শেষ রশ্মি মিলিয়ে গেলে ওর অনেক কান্না পেতো। চা ফেলে দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে থাকত। মাজহার ঘরে ফিরে অনেক আদর করত, টেনে উঠাত। ভালোবাসায় আদরে সোহাগে মাতিয়ে দিত। এক একটা হাসির এটম বোম ফোটাতো, শোনে হাসি এসে যেত তাও মুখ ভার করে থাকত জিনিয়া। কখনো কিনে আনা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে মুখে সুড়সুড়ি দিত। কখনো হাত টেনে পরিয়ে দিত চুড়ি। অনেক যত্ন করে অভিমান ভাঙ্গাত। তিন বছরের সংসারে একজন আরেক জনের শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে ছিল। এক দণ্ডের আড়ালে যেন দম বেরিয়ে যাবে। মাজহার জানত জিনিয়ার অভিমান কেমন করে ভাঙ্গাতে হয়। জিনিয়াও মাজহারের সুখের জন্য যা করতে হবে সব জেনে ছিল। কোথাও কোনো অপূর্ণতা ছিল না। খুনসুটি অভিমানের মাঝে আনন্দ, সুখের সন্ধান পেয়েছিল দুজনে।
মাজহার বিএ পাস করে অফিসে কেরানির চাকরি পেয়েছে, ঢাকায় থাকে মেসে। অভিভাবকের পছন্দে বিয়ে ঠিক হয় জিনিয়ার সাথে। বিএ প্রথম বর্ষ দিয়েছে জিনিয়া তখন। বিয়ের পয়গাম এলে স্কুলের কেরানি বাবা রাজি হয়ে যান পাত্র ভালো পেয়ে। এক বছর শ্বশুর বাড়িতে থাকে জিনিয়া, সপ্তাহান্তে মাজহার আসা-যাওয়া করে ঢাকা থেকে। এরপর একটা দু’রুমের ঘর নিয়ে জিনিয়াকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। সুখের শুরু সেই থেকে। সুখের দিনগুলো যেন বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তিন বছর সময় ওরা ভাসছে আনন্দে আহলাদে, সে সময় দেশের ঈশান কোণে মেঘ দেখা দেয়। দুজন ছাপোষা মানুষ কারো সাতে-পাঁচে নাই, স্বামী চাকরি করে, স্ত্রী ঘর সংসার করে। দেশের আন্দোলন নিয়ে ওদের মাথাব্যথা নাই। ওরা আছে নিজের মতন। অথচ নিজের মতন থেকেই কি ওরা রেহাই পেলো কোনো কিছু থেকে ?
উনিশশো একাত্তর সাল, মার্চের শুরু থেকে চলেছে আন্দোলন। মিছিল, মিটিং, প্রতিরোধ হরতাল। অফিসের সময় একদিন সকালে, আরেক দিন দুপুরে। সাত মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর থেকে বদলে গেছে যেন সব নিয়ম-কানুন। রাস্তা মানুষে ছয়লাব। কী যে উত্তেজনা চারদিকে। জিনিয়ার সুখের সময় কেমন যেন বদলে গেল। কখন অফিস কখন বাসা ঠিক-ঠিকানা নাই। খুনসুটি ভালোলাগার সময় কোথায় যেন ফুৎকারে চলে গেল। মাজহার আন্দোলন, মিছিলে যায় না। তবে পাড়ায় লোকের সাথে কথা বলে শোনে প্রতিদিনের খবর। কেউ বলে ঢাকায় আর্মি নামবে। কেউ বলে যুদ্ধ লাগবে। পাড়াপ্রতিবেশী অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। চাল, ডাল, নুন, তেল বেশি করে কিনে রাখছে। জিনিয়া বলে চলো আমরাও ঢাকা ছেড়ে যাই। জিনিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে মাজহার বলে, আমরা ছাপোষা মানুষ কারো সাতে-পাঁচে নাই, মিটিং, মিছিল করি না, আমাদের কি হবে। আমাদের কোনো ভয় নেই।
পঁচিশে মার্চ রাতে কেয়ামত হয়ে গেল যেন ঢাকা শহরে। আলোর ঝলক আকাশ আলো করে থাকল দিনের মতন। গুলি, আগুন ঢাকা শহরে তাণ্ডবলীলা সারা রাত। ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের নির্মম পাশবিকতায়, নির্বিচারে মারল পাকি মিলিটারি। রক্তের বন্যায় ভাসল রাজধানী। কচুরিপানার মতন মানুষের লাশ ভেসে যায় নদীর জলে। ছাপোষা মানুষদের ছারপোকার মতন মারল। ছারখার করে দিল ঢাকা শহর। নিরীহ নির্বিবাদী যাই হও দোষ একটাই, বাঙালি হওয়াই দোষ। তাই মরতে হবে। পাকিরা যেন আজরাইল, বাঙালির মৃত্যুর পরোয়ানা তাদের হাতে। জিনিয়া বলে, চলো ঢাকা ছেড়ে যাই, মাজহার তবু ছাপোষা মানুষের কথা বলে। কই যাবো, কি খাবো, আমাদের কি জমানো টাকা আছে? জিনিয়া বুঝে পায় না আর মানুষের কত টাকা, কোথায় পালাল সব, কেমনে? কয়েক দিনের মধ্যে সব নাকি ঠিকঠাক হবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক, রেডিওতে নির্দেশ দিচ্ছে, মানুষ যেন নিজ নিজ কাজে যোগ দেয় অথচ বিকাল থেকে কারফিউ থাকে প্রতিদিন।
মানুষদের কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। ছাপোষা মাজহার কাজে যোগ দেয় এপ্রিল মাস থেকে।
ভালোলাগা, সুখের অনুভূতি উধাও হয়ে গেছে যুদ্ধের জাঁতাকলে। যতক্ষণ মাজহার অফিস থেকে বাড়ি না আসে জিনিয়ার জানে পানি থাকে না। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে, মাজহার বলে ভয়াবহ সব ঘটনা। রাস্তায় লাইন দিয়ে মানুষ চেক করে মিলিটারি, যারে ইচ্ছা ছাড়ে যারে ইচ্ছা ধরে। বাস থেকে নামিয়ে লাইন দিয়ে মানুষদের দাঁড় করিয়ে চেক করে। একদিন মাজহারকেও লাইনে দাঁড় করেছিল। অফিসের পরিচয়পত্র দেখে ছেড়ে দিয়েছে। ট্রাকে করে চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা মানুষ নিয়ে যায় প্রতিদিন। কই নেয় কেউ জানে না। মানুষের শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে শেষ বিন্দু রক্ত বের করে নাকি মানুষ মেরে ফেলে। ভয়াবহ সব বর্ণনা শোনে শিউরে উঠে শরীর। ভয়ে আতংকে দিশাহারা হয়ে যায় জিনিয়া। মাজহারের পায়ে ধরে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। মাজহারের ঐ এক কথা, আমাদের কিছু করবে না।
পড়শীদের বাড়িগুলোতে নতুন মানুষ থাকে। কেমন যেন ওদের চালচলন। এই যুদ্ধের বাজারে ওরা খুব খুশি মনে হয়। একদিন মাজহার অফিস থেকে আসে চোখ মুখ ফোলা, পিঠে ডাণ্ডার বাড়ি নিয়ে। কেমনে হলো?
অফিসের ভিতর মিলিটারি ঢুকে পিটিয়েছে। দুই-চারজন মারাই গেছে। অফিসের পাশেই পাকি আর্মির ট্রাকে বিচ্ছুরা বোমা মেরেছিল। ট্রাক উল্টে মরেছে পাকি আর্মি। তাই আশেপাশের সব জায়গায় রেইড করে তাণ্ডব চালিয়েছে মিলিটারি, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।
ঐদিন মাজহার বলে গোছগাছ করো, ঢাকা ছাড়তে হবে। কিন্তু সেই রাত পোহানোর আগেই পাশের বাড়ির নতুন পড়শীর সাথে আর্মি আসে বাসায়। লোকটা মাজহারকে বলে, কতবার বললাম রাজাকারের দলে নাম লিখাতে শুনলে না, এবার তার খেসারত দাও।
ভয়ে কাঁপতে থাকা জিনিয়াকে একজনের পর একজন পাকিস্তানি আর্মি ধর্ষণ করে মাজহারের চোখের সামনে। চোখ বন্ধ করলে বন্দুক দিয়ে পিটায় আর বলে দেখ বেটা মজা দেখ। আধামরা জিনিয়াকে মিলিটারিরা ক্যাম্পে নিয়ে যায় সাথে করে। ছয় মাসব্যাপী প্রতিদিনের সে অমানুষিক নির্যাতন এখনো জিনিয়াকে পাগল করে দেয়। বুক শুকায়ে কাঠ হয়ে যায়। কোনো মেয়ে সুযোগ পেলে আত্মহত্যা করত নয়তো আক্রমণ করত সৈন্যদের। তাই কাপড় খুলে উলঙ্গ অবস্থায় হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত মেয়েদের। প্রয়োজন মতন জন্তু-জানোয়ারের মতন যৌন ক্ষুধা মেটাত মেয়েদের উপর।
সে আতংক স্মৃতি এখনো তাড়া করে ঘুমের মাঝে পালাতে চায় জিনিয়া আর্মি ক্যাম্প থেকে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে ঐ ক্যাম্পে আটকে থাকা অর্ধশত নারীকে। চিকিৎসা দেয়া হয় তাদের। বিদেশি এনজিওর অধীনে চিকিৎসা চলে জিনিয়ার। শেখ মুজিব নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি দেন।
মেয়েদের থেকে ঠিকানা নিয়ে তাদের পরিবারে যোগাযোগ করা হয়। মেয়েরা আশায় পথ চেয়ে থাকে। দু-একজনের আত্মীয় দেখা করতে আসে, এক দুই জনকে বাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু বেশির ভাগ মেয়েদের দেখতে কেউ আসে না। নিতেও কেউ আসে না। জিনিয়া দিনের পর দিন অপেক্ষা করে মাজহারের আসার, বাবা-মায়ের আসার। কেউ আসে না । ভয় হয় সে কি বেঁচে আছে, কোথায় আছে?
কিছুটা সুস্থ হয়ে একদিন জিনিয়া মাজহারকে খুঁজতে যায় ঢাকার বাসায়। মাজহার বাসায়ই ছিল। ওর সাড়া পেয়ে বেরিয়ে আসে। দুই হাতে জড়িয়ে ধরে, আদরে ভালোবাসায় যে বউর অভিমান ভাঙ্গাত। গোলাপের তোড়া, বকুলের মালা ছড়িয়ে দিত গায়ের উপর, দুহাতের পাতায় জিনিয়ার মুখখানা ধরে অপলক তাকিয়ে থাকত। কানে কানে বলত কত ভালোবাসার কথা, হাসির কথা। সেই মাজহার জিনিয়ার দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থাকল। ও যেন অস্পৃশ্য পাপী, মাজহার যেন জিনিয়াকে কোনো দিন চিনে না, দেখেনি। ও যেন অন্য কোনো গ্রহের মানুষ দেখছে তেমনি অবাক চোখে তাকায় জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া প্রথমে বুঝতেই পারেনি মাজহারের ব্যবহার। ও ভেবেছে এত কষ্ট যন্ত্রণায় সত্যি মনে হয় চিনতে পারছে না জিনিয়াকে। ও নিজের পরিচয় দেয়, মানু আমি তোমার জান জানু জিনিয়া চিনতে পারছো না?
কোনো সাহসে এখানে এসেছো? এখুনি চলে যাও ভাগো। আর কখনো এখানে আসবে না নষ্টা মাগী ।
কী! কী বললে তুমি?
কোনো কথা নয়, চলে যাও এক্ষুণি। চলে যাও এখান থেকে।
বিস্ময়ে বোবা হয়ে যায় জিনিয়া। বিহবল জিনিয়া বুঝতে পারে না কি তার অপরাধ? নরপশু ওকে গায়ের জোরে খুবলে খেয়েছে এতে ওর কি অপরাধ? তুই কি স্বামী হয়ে বাঁচাতে পেরেছিলি আমাকে নরপশুর হাত থেকে ? ঢাকা ছেড়ে যেতে চেয়েছিলাম শুনেছিলি আমার কথা?
এক দলা থুথু ফেলে চলে এসেছিল জিনিয়া। আর কখনো কারো খোঁজ করেনি। স্বাধীন দেশে সব হারানোর পরাধীনতা নিয়ে অনেক কেঁদেছিল সেদিন জিনিয়া। ওর কি দোষ, অপরাধ বোঝে পায় না জিনিয়া। নির্যাতিত পুরুষ মানুষের কেউ দূরে সরিয়ে দেয়নি, ছি ছি করেনি। তবে নির্যাতিত মহিলাদের কেন সবাই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। স্বাধীন দেশে যাদের বীরাঙ্গনা নামে ভূষিত করেছেন জাতির পিতা। যারা নীজেরাই অপমান, গ্লানি আর সব হারানোর ব্যথায় জর্জরিত। পরিবার, সমাজ তাদের গ্রহণ করছে না। বিতাড়িত সেসব মহিলার জীবনে হয়ে উঠল কান্না সম্বল।
অল্প কিছু মেয়ে ছিল সৌভাগ্যবতী। জাতির পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে অল্প কিছু মুক্তিযোদ্ধা জীবন সঙ্গিনীর মর্যাদা দেন বীরাঙ্গনাদের। সেসব মেয়ে সংসার করতে চলে যায় তাদের উদার স্বামীর হাত ধরে। বেশিরভাগ মহিলা হতাশার জীবনে পড়ে থাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এনজিও থেকে অনেক মেয়েকে ওরা বিদেশে পাঠাচ্ছিলেন যাদের কেউ খোঁজ করতে আসে নাই বা এলেও বাড়ি নিতে চায় না, যারা বিদেশ যেতে আগ্রহী তেমন মহিলাদের। জিনিয়াকে কানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন বিদেশি সংস্থার মহিলা ক্যারলিনা। স্বাধীন দেশ ওদের ত্যাগের মূল্যায়ন করলেও সংকীর্ণ সমাজ পরিবার তাদের মূল্যায়ন করেনি। স্বাধীন হওয়া নিজের দেশ হয়ে যায় অচেনা বিদেশ, আপনজনরা সব অচেনা। একা হয়ে যাওয়া জিনিয়া সব ছেড়ে পাড়ি দেয় অজানা অচেনা বিদেশে। কানাডা সরকার ওর থাকা-খাওয়া, পড়ালেখার সব দায়িত্ব নেয়। অজানা ভাষা, চালচলন, সব কিছুর সাথে মানিয়ে নেয় নিজেকে ধীরে ধীরে। পড়ালেখা করে নিজেকে উপযোগী করে তুলে কানাডার সমাজের। কাজে লেগে যায় স্যোশাল ওয়ার্কার হিসাবে। ওকে আপডেট করার জন্য সরকার যে টাকা ঋণ দিয়েছিল, কাজ করে সব ঋণ ফিরিয়ে দিয়ে, নিজের বাড়ি কিনে সুখেই আছে অচেনা আপন মানুষের সাথে। ভুলে যায় আপনজন।
বহুদিন বাদে বিভীষিকাময় সেই স্মৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয় স্বামী আর নতুন প্রজন্মের দুটি যুদ্ধ না দেখা যুবক-যুবতীর কাছে।
কোনোদিন স্যামুয়েল ছাড়া আর কারো কাছে এভাবে বুকের কষ্ট উদঘাটন করেনি জিনিয়া। এতটুকু ভুলে যায়নি সেসব স্মৃতি এত বছর পরও। সব মনে আছে। শুধু বুকের ভিতর চাপা পড়ে ছিল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলে জিনিয়া দুর্বিষহ সেই স্মৃতি। কথা থেমে গেছে দুঃসহ বেদনায়, নীরবতা নেমে আসে সবার মাঝে। শিউরে উঠে জিনিয়ার সব কষ্ট বুকে ধারণ করে স্যামুয়েল, জড়িয়ে রাখে জিনিয়াকে মমতায় ভালোবাসায়। যতবার শুনেন এক কথা বেরিয়ে আসে স্যামুয়েলের মুখে,
ওহ গড… ভয়াবহ, ভয়াবহ, বারবার এ কথা বলতে থাকে স্যামুয়েল। আমার গ্রান্ডমার উপর এমন অত্যাচার করেছিল জার্মানিরা শুনেছিলাম। ভাবতে পারি না মানুষ কেমন করে এত নিষ্ঠুর হয়।
তাতাই আঁকড়ে ধরেছে তিতাসের হাত শক্ত করে। ওর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে ফুলে ফুলে।
তাতাই আর পারছে না নিতে এত কষ্ট।
এই মানুষ ওদের অর্ধেকের বেশি জীবন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে দুঃসহ স্মৃতির বোঝা। জিনিয়ার কষ্টে ওর বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অস্থির হয়ে কেঁদেই যাচ্ছে তাতাই।
রাতের খাবার টেবিলে তাতাই নাই। ওর অনুপস্থিতিতে অস্থির হয়ে উঠলেন আবেদিন সাহেব।
– কি ব্যাপার আমার মাটা কই লিমার মা?
– ও নাকি খাবে না রাতে, শুয়ে পড়েছে।
– সে কি, শরীর খারাপ? আবেদিন আহমেদ উতলা হন। আমি দেখে আসি।
তাতাই শুয়ে আছে বাতি নিভিয়ে। আবেদিন আহমেদ ঘরে ঢুকে ডাকেন,
– তাতাই মা মণি, ঘুমাচ্ছো?
– না মামা।
– খেতে চলো তাহলে।
– খাবো না, গলার স্বর ভারী। থমকে যান আবেদিন আহমেদ। কি ব্যাপার, কাছে এগিয়ে যান, পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে বসেন তাতাইর পাশে। ওর চুলে হাত দিয়ে বলেন,
– রাতে না খেয়ে থাকাটা ভালো না।
– খেতে ইচ্ছা করছে না মামা ঢেকে রাখা মুখটা বের করে বলে তাতাই। ওর চোখ মুখ ফোলা। চমকে আবেদিন আহমেদ বলেন,
– কি হয়েছে তোর মামণি ? মামার কোলে মুখ রেখে কেঁদে উঠে তাতাই। অপ্রস্তুত আবেদিন আহমেদ অস্থির গলায় বলেন,
– কে কি করেছে তোকে মা?
তাতাই স্থির হয় কেঁদে কেঁদে বলে,
– মামা ওদের জন্য আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তাতাইর কথা কিছু শুনে উনি বলেন,
– তোর আমার মতন আরো অনেকেই ওদের জন্য কষ্ট পায়। যাদের উপর দিয়ে অত্যাচারের ধকল গিয়েছে তাদের দেয়ার কোনো সান্ত্বনা আমাদের নেই। তবে জাতীয়ভাবে যদি কিছু করা হতো ওদের সবার জন্য তবে ভালো লাগত।
বুঝিয়ে নিয়ে আসেন তাতাইকে খাবার টেবিলে আবেদিন আহমেদ।
দুপুরের সেই প্রাণবন্ত মেয়েটা নাই। খাবার টেবিলেও দুপুরের হাসি আনন্দের জোয়ার বইল না। স্যামুয়েল চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন। জিনিয়াও খেতে আসেনি। কুলসুম বিবি বরাবরের মতন নীরব। তাতাই তিতাস দুটো তরতাজা প্রাণ কেমন নিথর। আবেদিন আহমেদও তাতাইকে নিয়ে আসার পর আগের উচ্ছ¡াসে ফিরে গেলেন না। জয় আর সাজিদ দুজন বাড়ি নাই। ওদের সাথে দেখা হলো না। সামিয়া ও হারুন একটু অস্বস্তি অনুভব করছেন এই নীরবতায়। প্লেট চামুচের টুংটাং শব্দ বড় বেশি কানে বাজছে।
যে যার ঘরে চলে যাচ্ছেন সামান্য শুভরাত্রি বলে। দুপুরের জমজমাট বাড়িটা নিথর নীরবতায় ছেয়ে আছে।
তিতাস শুতে যাচ্ছিল, সামিয়া ডেকে বললেন,
– তুই কিছু বুঝতে পারলি?
– কি বিষয়ে মা ?
– দুপুরের হাসিখুশি বাড়িটা হঠাৎ কেমন বদলে গেল যেন।
– সি ইজ ভেরি সেনসেটিভ মা।
– কে?
– তাতাই।
– তাই নাকি, কি রকম ? আজ দুপুর থেকে এমন ভয়াবহ দুটো ঘটনা ও জেনেছে সেটার ধকল সামলে উঠতে পারছে না।
সামিয়ার অন্যের পারিবারিক বিষয়ে তিতাসকে জিজ্ঞাসা নিয়ে হারুন বাধা দিয়ে বলেছিলেন,
– থাক না অন্যের বিষয়ে কথা বলা।
– ব্যক্তিগত কোনো বিষয় না বাবা।
তিতাসের মুখে সব শুনে এখন ওরা দুজনও মন খারাপ করে বসে আছেন। দু’চোখে অশ্র“ নিয়ে সামিয়া ভাবছেন, মেয়েটা এত মায়াবতী কেন ? সেই সাথে অনেক কষ্ট পাওয়া জিনিয়াকে চিনেন নতুন করে। খুব যন্ত্রনা হতে থাকে বুকের ভিতর। কত মানুষের জীবন উল্টপাল্ট করেদিয়েছে এই যুদ্ধ?
ভোরবেলা অনেক পাখির গানে সামিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে এসে খালি পায়ে সবুজ শিশির ভেজা ঘাসে হাঁটতে খুব ভালো লাগল। এমন সুন্দর একটা সকাল ঢাকায় কখনও পান না। এমন বাড়ি রেখে মানুষ ঢাকায় থাকে কেন? আবেদিন আহমেদের কাজ ব্যবসা এখানে নিয়ে এলে এই গ্রামও কি ঢাকার মতন বিষাক্ত ধূয়ায় ঢাকা হয়ে যাবে? গাছগাছালি ছাওয়া পরিষ্কার অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাস লম্বা শ্বাসে বুক ভরে নিচ্ছেন সামিয়া। বেশ মজার যেন এক খেলা।
হঠাৎ চোখে পড়ল কোণের দিকে দোলনায় তাতাই বসে আছে একা। মেয়েটা এত ভোরে উঠে পড়েছে, সারারাত কি ঘুমায়নি ? এগিয়ে গেলেন মেয়েটার কাছে।
কেমন আছো তাতাই?
জী ভালো।
কোনো কথা নয়, মেয়েটাকে অনেক আদর করতে ইচ্ছা করছে। সামিয়া বললেন,
আমার কাছে এসো তাতাই ।
উঠে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল তাতাই? বুকে টেনে নিয়ে অনেক আদরে জড়িয়ে রাখলেন সামিয়া মেয়েটাকে। ঘুম ভেঙ্গে বাইরে এসে এই দৃশ্যটা চোখে পড়ল তিতাসের। অসম্ভব সুন্দর স্নিগ্ধ এই দৃশ্যটা ও চুপি চুপি ওর ক্যামেরায় বন্দি করল।

অনেকক্ষণ পর এক সময় আস্তে আস্তে সামিয়া বললেন,
আমি সব শুনেছি তিতাসের কাছে। তুমি এযুগের মেয়ে, দেশের বাইরে বড় হয়েছো কিন্তু একটা দেশের জন্ম সময়ের দুর্বীনিত দুঃখগাঁথা তুমি যেমনভাবে অনুভব করছো তোমার হৃদয়ে, আমি অভিভূত। দোয়া করি তোমার ভালো হোক সব কিছুতে। আমরা সে সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। হৃদয়ের সাথে জড়িত তাই সেই সব স্মৃতি। দেশে এখনো অনেক কিছুর অসামঞ্জস্য বড় কষ্ট দেয়। তবে তোমাদের মতন নতুন প্রজন্ম যে এটা উপলব্ধি করছো, বুকে ধারণ করছো এটা আশার আলো দেখাচ্ছে। এবার আমার আশা হচ্ছে, দেশের মানুষ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে তোমার মতন অনুভব করবে। কিছু করার চিন্তা করবে। এই দেশের হিরোদের জন্য। তোমার মামার কথাই ঠিক, আমাদের সঠিক ইতিহাস বারবার তুলে ধরতে হবে।
কুলসুম বিবি হেঁটে আসছেন পুকুরের দিক থেকে, সে দিকে চেয়ে সামিয়া বলেন,
তাতাই জানো কুলসুম বিবিকে এত বছর পর খুঁজে পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি আরো কিছু মানুষ খুঁজছি। যাদের সাথে জীবনের একটা সময়ে আমরা পরিবারের মতন হয়ে গিয়েছিলাম। কে যে কোথায় হারিয়ে গেল আর দেখা পাইনি।
অবশ্য কুলসুম বিবিকে খুঁজে পাওয়ার সব কৃতিত্ব তিতাসের।
তাই নাকি ?
ও জানতো না আমরা ওকে চিনি। যখন সব শুনলাম ওর কষ্টের কথা, বললাম তিতাস ওর কাছে আমাকে নিয়ে যা। তিতাস আমাকে বুঝিয়ে রেখে গেল। বলে গেল কুলসুমকে নিয়ে আসবে। অপেক্ষা করছি, তিন চার দিন তিতাসের কোনো খবর নাই। পাঁচ দিনের দিন ওকে নিয়ে এলো। ওর তো কোনো ঠিকানা নাই, কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। কয়েকটা গ্রাম খুঁজে তিতাস ওকে পায় যার জন্য সময় লাগে কয়েক দিন। তবু ভালো, পেয়েছে শেষ পর্যন্ত।
ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাতাই ভাবে মনে মনে।
জিনিয়া মেয়েটার কত দুঃখ।
তবু বহু বছর পরে স্যামুয়েলের মতন একজন সুন্দর মনের মানুষ সে পেয়েছে। যে তাকে ভালোবাসায় আগলে রাখছে। আমাদের দেশে মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন কবে হবে ?
সামিয়ার সাথে কথা বলে ভালো লাগে তাতাইর। বলে,
চলেন নাস্তা করতে যাই। মামী আজ শীতের পিঠা দিয়ে নাশতা দিবে। গড়ম গড়ম সব তৈরি হচ্ছে।
তুমি পিঠা পছন্দ করো ?
আগে করতাম না, এখন খুব ভালোবাসি।

- Advertisement -

তাতাই জয়কে খুঁজছে। কাল থেকে জয়, সাজিদ দুজনের সাথে একবারও দেখা হয়নি। ওরা কোথায় কি করছে। এত সকালে উঠেনি, কাল রাতেও কি অনেক দেরি করে ফিরেছে দুজন?
তাতাই, সামিয়া, কুলসুম বিবি, আবেদিন আহমেদ, হারুন, আয়শা, স্যামুয়েল সবাই নাশতার টেবিলে। জিনিয়া এখনো উঠেনি। কাল রাতে ঘুমাতে পারেনি, শেষে ঘুমের ঔষুধ খেতে হয়েছে এখন ঘুমাচ্ছে। তিতাস এসে যোগ দিল নাশতার টেবিলে।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent