মঙ্গলবার - এপ্রিল ২৩ - ২০২৪

একটি সোনালি দিন

ছবি তেডাস পেট্রোদাস

আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দিনই ছিল এক একটি সোনালি দিন।
অবশ্য রূপকথার গল্পের মতো বলে রূপালি দিনও বলা যেতে পারে। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ছিল বহুমূখী প্রতিভাধর, আবার কেউ কেউ বৈচিত্রময়ী। আমি ছিলাম কিছুটা নিরব স্বভাবের এবং চুপচাপ। কোন ঝামেলা নেই মিছিল, মিটিং আর রাজনীতির। পড়াশুনা, বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স কালচার’ আর মৌচাষ, এই নিয়েই আমার জগৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের যত ঝামেলা সবই শুধু রাজনৈতিক কর্মীদের। এক দলের কর্মী অন্য দলের চক্ষুশূল, যেন কাল সাপ। বন্ধু আনোয়ার হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অহর্নিশ, এক হল থেকে অন্য হলে, ক্যাম্পাস থেকে শহরে। তবে আমার অবস্থা ভিন্ন, ক্যাম্পাসে আমার অবস্থা অনেকটা তৃণসম। নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াই আর দেদারসে সাবাড় করি ক্যম্পাসের আম-কাঁঠাল সবই। যদিও একা না, আশে পাশের সব রুমমেটদের নিয়ে।
কাঁঠাল খাওয়ার গল্পটি বেশ মজার।
আমার রুমমেট লোকমান খুব ভোরে উঠেই হলের নামাজ রুমে গিয়ে নামাজ পড়ে। ফিরে এসেই ডাকতে থাকে আমাকে, সে কাঁঠাল পাড়তে যাবে কিন্তু একা যেতে চায় না, খুব সঙ্কোচ তার। কী আর করা, রুমমেট বলে কথা, পাশাপাশি বেডে থাকি, কথা না শুনে উপায় কি?
হলের সামনের রাস্তায় বেরোতেই একটি টোকাই ছেলেকে পেয়ে গেলাম।
লোকমান কাঁঠাল চিনতে বেশ পটু। হলের সামনের রাস্তার দু’পাশে সারি সারি কাঁঠাল গাছ। সে টোকাইকে দেখিয়ে দিচ্ছে কোনটা কোনটা পরিপক্ক হয়েছে সেটা পাড়তে। আমার কাজ হলো টোকাইকে রুম খুলে দিয়ে সব কাঁঠাল আমার খাটের নিচে জড়ো করানো। আর কেউ জানতে চাইলে বলতে হবে সব কাঁঠাল পাড়া হয়েছে লোকমানের নির্দেশে। সব সামাল দেয়ার দায়িত্ব লোকমা্নরে, প্রভাবশালী সংগঠনের নেতা হওয়ায় তার দাপট যথেষ্ট, তাই আমিও আস্থাশীল। পরে দেখলাম কাঁঠাল এনেছি আমরা কিন্তু খাচ্ছে সবাই। রুমের সামনে দিয়ে গেলেই পাকা কাঁঠালের ম-ম গন্ধ বন্ধুদের সব জড়ো করে আমার রুমে।
এমনি এক কাঁঠালি দিনের কথা।
সামনেই গ্রীষ্মের ছুটি, তবে লীগ আর শিবিরের মধ্যকার মারমুখী সংঘর্ষের কারণে আগাম হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বন্ধু ইমাম শাহীন বারান্দা দিয়ে যেতেই আমার রুমে টোকা। বলছে গন্ধ পাইতাসি কাডলের, আমি বললাম সব খাটের নিচে, যা পারো খাও, বাকি সব ফেলে দিতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হল ত্যাগের জন্য রেডি হয়ে দোতলায় গেলাম বন্ধু কবিরের রুমে, সাথে কাঁঠালও। সবাই রেডি হলো, কেউ কেউ কাঁঠালও খেলো, খায়নি শুধু একজন, ফর্সা করে মাথা মোড়ানো একটি অল্প বয়সের ছেলে। নাম তাঁর আমিনুল। বন্ধু কবির বলল, ছেলেটি ওর একই গ্রামের। কি কারণে যেন কিছুদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ছিল, এক সময় মাথা ন্যাড়া করে ফেলে, এখন সব ঠিক হয়েছে। কোন এক প্রভাবশালী দলের রাহুমুক্ত হয়ে এখন সে স্বাধীন, থাকছে লীগের রুম নামে খ্যাত কবিরদের রুমে। অনেক সাধা-সাধির পরও সে কাঁঠাল খেলো না। বললো ভাইয়া রোজা রেখেছি, কাঁঠাল খেয়ে রোজাটা আর ভাঙতে চাই না। কে জানত তখন এই রোজাই হবে তার শেষ রোজা, এই খালি মুখেই তাকে ছাড়তে হবে মায়াবী এই ভুবনের মায়া!
বিকেল পাঁচটার আগে আগেই আমরা সবাই চেপেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে। মুখোমুখি সিটের একপাশে বসেছি আমি আর হিমু, অন্য পাশে নিশু আর তাঁর বান্ধবী দীনা। আজ আমার বন্ধুটি হয়তো পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন। হল ছেড়ে যাচ্ছে নিজের বাসায়, স্বজনদের কাছে। তাছাড়া সামনেই বসে আছে তার প্রতিমা, যার দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চায় সারাক্ষণ। তারপরও কেন যেন হিমুর মন খারাপ। কাব্য নেই, ছন্দ নেই, শুধুই শঙ্কা। ফিসফিস করে আমাকে বলছে,
: অবস্থা ভাল না, তাকিয়ে দেখ ট্রেনের বাইরে, কাকে যেন খুঁজছে ওরা।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আশঙ্কা সত্যি হলো।
খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং গায়ে চাদর মোড়ানো একজন আমাদের শাটলের কামরায় উঠল। তার সাথে আরো দুই সহোচর। মনে হয় কাউকে খুঁজছে, তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। হঠাৎ ক্যাডারদের নজর পড়ল আমাদের দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের সবার সামনেই ছোঁ মেরে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে নিল হিমুকে। আমি কাপুরুষের মতো নির্বিকার তাকিয়ে থাকলাম, তাকিয়ে থাকল কম্পার্টমেন্টের সবগুলো মানুষ, জীবনের মায়া বলে কথা। আর হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকল নিশু। বুঝতে পারছিলাম না এ মুহূর্তে আমার কি করা উচিৎ। একবার ভাবছি ট্রেন থেকে নেমে বন্ধুকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, আবার ভাবছি পলিটিক্যাল মার কেমন হয় কে জানে। বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে মার না হয় খেলাম কিন্তু যদি রগ কেটে পঙ্গু করে দেয় তাহলে কিভাবে বাঁচবো সারা জীবন?
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতোই মাথায় বুদ্ধি এলো।
নিশুকে বললাম, ফ্যান ফ্যান করে এখানে মায়া কান্না না করে বরং তুমি নিচে নামো, ওকে বাঁচাও। মেয়েদের গায়ে ওরা হাত তুলবে না। যেই কথা সেই কাজ নেমেই নিশু চিৎকার করে পুরোপুরি ফিল্মি স্টাইলে জড়িয়ে ধরলো হিমুকে। একদিকে টানছে ক্যাডাররা অন্যদিকে টানছে নিশু। তাকিয়ে আছে সারা ট্রেনের সব ছেলে মেয়ে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ভাগ্য এতো সুপ্রসন্ন যে, অভাবনীয় মানবিক আবেগের এ দৃশ্যটি চোখে পড়ল টহল দিতে আসা জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার। তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে মুক্ত হলো আমার কবি বন্ধু। হিমুর সেই যে বেঁচে যাওয়া, বেঁচে সে আছে আজও। বেঁচে আছে গত বাইশ বছর মাতৃভূমির সব মায়া ছেড়ে এই শ্বেত ভল্লুক আর বল্গা হরিনের দেশে। তাকে হয়তো এখন আর দেশ টানে না, স্বজন টানে না, টানে না বন্ধুর মায়া। তার বন্ধনহীন এই জীবনকে কি বলা যায় আমি জানি না, তবে এটা যে সন্ন্যাস কিংবা বৈরাগ্য নয়, এটা আমি নিশ্চিত।
আপাতঃ দৃষ্টিতে ট্রেনের এই ঘটনাটি রোমাঞ্চকর এবং স্বস্তিদায়ক।
যদিও এর পরের অধ্যায় ছিল ভয়ঙ্কর, লোমহর্ষক এবং হৃদয় বিদারক। পলিটিক্সের খেলা যে কতটা নোংরা এবং ভয়ঙ্কর তাঁর এক নিরব সাক্ষী হয়ে আমাকে আর কতদিন বেঁচে থাকতে হবে জানি না। উনিশ’শ সাতাশি সালের মে মাসের এই ঘটনার সাক্ষী সেই সময়কার শত শত ছাত্র ছাত্রী।
হিমু আর নিশুর আবেগপূর্ন মিলনের আনন্দঘন মুহূর্তেই ছেড়ে দেয় আমাদের শাটল ট্রেন। ষোলশহর স্টেশনে নেমে যায় হিমু-নিশু সহ আমাদের অনেক বন্ধু। আমার সামনের খালি জায়গা পূরণ করে কবির, মনির এবং সেই ন্যাড়া মাথায় টুপি পড়া আমিনুল নামের চুপচাপ ছেলেটি। শাটল চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছার পর আমরা সবাই মিলে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে আশ্রয় নিলাম। উদ্দেশ্য রাত আটটার বাহাদুরাবাদ ট্রেনে কুমিল্লা যাব। একসাথে সবার হল ত্যাগ, তাই সেদিন ট্রেনে খুব ভিড়। সিদ্ধান্ত হলো সবাই ডকে গিয়ে আগাম জায়গা দখল করব। বাঁধ সাধলো আমিনুল বলল: ভাইয়া,রোজা রেখে আমি খুব ক্লান্ত। আপনারা সবাই গিয়ে ডকে জায়গা দখল করে মেইন স্টেশনে এলে আমি উঠব। আপাততঃ আমি সবার লাগেজ পাহারা দেই।
হৈ হুল্লোড় করে আমিনুল বাদে আমরা সবাই গেলাম ডকে।
ছোট একটি কামরার মোটামুটি পুরোটাই দখল করলাম আমরা। ফিরে এসে কয়েকজন গেল সবার লাগেজ গুলো আনতে। আমি বসে রইলাম ট্রেনেই। কিছুক্ষণ পর কবির এবং মুনির হাঁপাতে হাপাঁতে ফিরে এলো, যদিও ফিরেছে ব্যাগ ছাড়াই। বলল,
: কেউ একজন খুন হয়েছে ওয়েটিং রুমে, তাই পুলিশ তালা লাগিয়ে দিয়েছে। রুমে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা বলাবলি করছে টুপি পড়া ন্যাড়া মাথা ছেলেটাকে কয়েকজন এসে উপর্যপরি ছুরিকাঘাত করে মেরে ফেলেছে। এখন লাশ নিয়ে গিয়েছে সরকারি হেফাজতে এবং সাথে সাথেই ওয়েটিং রুম হয়েছে লক্ড।
পরে পুলিশ সবার ব্যাগ নেয়ার জন্য রুম খুলে দিলে আমাদের ব্যাগ গুলো নিয়ে আসা হয়। থেকে যায় আমিনুলের টুপি আর ব্যাগ। পরে সিদ্ধান্ত হয় মৃত আমিনুলের ব্যাগ টুপি আমরা সংগ্রহ করে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেব। শুধুমাত্র মানবতাবোধ থেকেই ছেলেটির বাবা-মাকে খবরটুকু পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অপ-রাজনীতির খেলা যে কতো নির্মম, এ যে মানবতা বুঝে না তাঁর নিষ্ঠুর প্রমাণ হাতে নাতে পেলাম পরদিন। যে দল হিমুকে বলি দিতে ব্যর্থ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারা তাদের প্রতিপক্ষ দলকে দায়ী করে এই খুনের জন্য। দুই দলের এই হোলি খেলায় প্রথম বলি নিরীহ আমিনুল। পরে যারা ব্যাগ পৌঁছে দিতে যায় তারা সবাই। খুনের মামলা দিয়ে তাদের জীবনেও ডেকে আনা হয় ঘন অন্ধকার। প্রায় বিশ বছর কোর্টের কাঠগড়ায় হাজিরা দিয়েই এদের প্রমাণ করতে হয়েছে এরা আসলে নির্দোষ।
ছয়.
বেশ কিছু দিন হলো আমার কথা হয় না নিশুর সাথে।
আমি নিজে থেকে যেমন কল করি না, নিশুও তেমনি।
আমার ফোন না করার কারণ হচ্ছে সবশেষ আমি যখন ওর সাথে কথা বলি, আমার মনে হয়েছে নিশুর মাথা বেশ এলোমেলো। তাছাড়া কথা বলছে তো বলছেই, থামছে না এক মুহূর্তের জন্যও। ভয় হয় খুব, মেয়েটির মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো?
এরপর দিন যায়, রাত যায়, কল আর আসে না।
বলা যায় অনেকটা দুশ্চিন্তা থেকেই একদিন আমার কল দেয়া। শত হোক বন্ধুতো. ভালো আছে জানলেই ভালো লাগে।
কিন্তু নিরাশ হলাম- ঘরের ফোন, মুঠো ফোন সবই বন্ধ। হঠাৎ মনে পড়লো কিছুদিন আগে নিশুর ফোন কলের কথা। কথার মাঝখানে আমি হঠাৎ ওকে থামিয়ে দিয়েছিলাম- জানতে চেয়েছিলাম ওর শরীর ভালো তো? ও বলেছিল-
: কেন জানতে চাও এই কথা? হিমু আমাকে বলেছে আমার সম্পর্কে একই কথা তুমি ওর কাছেও জানতে চেয়েছ।
: হ্যাঁ! আমি পুরো সুস্থ যদিও ডাক্তার আমাকে বলেছে আমি নাকি ‘মুড সুইং ডিস-অর্ডার’ এ ভুগছি। আসলে কি জানো এসব কিছুই না। আমার সমস্যা একটিই ‘ আমার মাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সহ্য করতে পারি না, এই যা।
ভেবে খুব দুঃশ্চিন্তা হয় আমার।
তাহলে কি এতো সুন্দর এই মিষ্টি মেয়েটি হাসপাতালে এখন?
আমার সব কল্পনার সংহার হলো হঠাৎ অবেলার কোন এক ফোন কলে।
অসম্ভব ভায়াল এক পুরুষালি ভৌতিক গলার ফোন কল। আমি শুধু বলে যাচ্ছি ‘মে আই নো হু ইজ কলিং?’ কিন্তু ভৌতিক গলা শুধু ভয় দিয়েই যাচ্ছে। কৌতুহলের কারণে ছাড়তেও পারছিনা ফোনটা।
বলছে-
: হ্যালো! কেমন আছো? কি অনেক দিন পর কথা বলছি বলে ভয় পেয়ে গেলে না তো? আমি যদিও কিছুতেই কন্ঠ বুঝতে পারছি না। এক পর্যায়ে নিজে থেকেই পরিচয় দিল সেই ভৌতিক কন্ঠ।
: নিশু, এটা তোমাদের নিশু। চিনতে পারছো না বুঝি? জানো আমি বহু রকমের গলায় কথা বলতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন নাটক করতাম তখনই শিখেছি।
আমি বললাম বাবা বাঁচা গেলো, প্রথমটায় আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যাক বলো, তুমি ভালো তো? খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম এতোদিন তোমাকে নিয়ে। মুহূর্তেই মেয়ে কন্ঠে জবাব এলো-
: না ভালো নেই, জানো আমাকে ওরা আটকে রেখেছে।
: কি বলছো? মজা করছো না তো?
: সিরিয়াসলি বলছি, আমি এখন হাসপাতালে। তোমাদের নিশুকে ওরা আটকে রেখেছে।
হঠাৎ কিছুটা চেঁচামেচির আওয়াজ আমার কানে ভেসে এলো।
মনে হলো কেউ একজন ফোনটা সরিয়ে নিলো এবং ইঞ্জেকশনের কথা বলছে। কয়েক সেকেন্ড পর আর কোন আওয়াজ নেইÑ সব স্তব্ধ। জানিনা হয়তো এই স্তব্ধতাই বলে দিচ্ছে নিশুর সীমাহীন না বলা কথা, মস্তিকের তন্ত্রীতে জমানো আজন্ম লালিত ব্যাথা।

উইন্ডসর, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent