খান জয়নুল-রবিউল-আলতাফ-সাইফুদ্দিন-আনিস এবং হাসমত নামের ছয় ছয়জন দুর্দান্ত অভিনেতা আমাদের কৈশোর-যৌবনের প্রারম্ভিক জীবনটাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন প্রবল হাস্যরসের বিপুল সম্ভারে।
ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিট-রবিদাস পাড়ায়(মুচিপাড়া) বসবাসের সুবাদে নিকট প্রতিবেশী ছিলাম অভিনেতা আলতাফ হোসেনের। বাহাত্তর সালের এক মনোরম বিকেলে যোগীনগর দিয়ে মুচিপাড়ায় ঢোকার পথে রিকশায় দেখলাম রাজু আহমেদ বসে আছেন। তার পাশ থেকে উঠে খান জয়নুল চলে যাচ্ছেন আলতাফের বাড়ির দিকে। সেই প্রথম আমার প্রিয় খান জয়নুলকে দেখা, সামনা সামনি। এই পাঁচজনের মধ্যে রবিউলের সঙ্গে আমার বিপুল সখ্য গড়ে উঠেছিলো হাসপাতালে পাশাপাশি কেবিনে ঠাঁই হওয়ার সুবাদে। আনিস ভাই ১৯৮৭ সালে বিটিভিতে আমার রচনা ও পরিচালনায় প্রচারিত ছোটদের ধারাবাহিক নাটক ‘ঝন্টু-পন্টু’তে অভিনয় করেছিলেন। ব্ল্যাক আনোয়ারকে একটু টাইট দিতে আনিস ভাইয়ের চরিত্রটির আগমন ঘটিয়েছিলাম। ব্ল্যাক আনোয়ার খুব ভোগাতেন রেকর্ডিং-এর দিন। সংলাপ মুখস্ত না করেই স্টুডিওতে চলে আসতেন।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও সিনেমার গল্প-চিত্রনাট্য রচয়িতা বন্ধু মুজতাব সউদের একটা পোস্ট চোখে পড়লো। আমাদের চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা রবিউলকে ভুলে গেলেও সউদ তাঁকে মনে রেখেছে। ১৯৮৭ সালের ১৮ এপ্রিল পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।
১৮ এপ্রিল রবিউলের প্রয়াণ দিবসে মুজতবা সউদ স্মরণ করেছে রবিউলকে। তার পোস্টে মন্তব্য করতে গিয়ে আক্রান্ত হলাম রবিউল স্মৃতিতে।
সময়কাল ১৯৮৪। আমার কিডনিতে মূল্যবান পাথর আবিস্কৃত হলো। প্রচন্ড ব্যথায় চিল্লাতে চিল্লাতে ভর্তি হলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনতলায় আমার কেবিন নাম্বার ২৩। দিন রাত অসহনীয় ব্যথায় চিৎকার করে হাসপাতাল কাঁপাই।
যন্ত্রণাকাতর আমার চিৎকারে অতিষ্ট হয়ে চিকিৎসক আমাকে পেইনকিলার ইনজেকশন ‘প্যাথেডিন’ দিয়ে কেবিনে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন। এই পেইনকিলার আমার যন্ত্রণার উপশম তো করতোই বাড়তি বোনাস হিশেবে আমাকে নতুন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও দাঁড় করাতো। আমি চিৎকার শুরু করলেই পরিবারের লোকজন নার্সদের ডেকে আনতেন। আমার কেবিনেই প্যাকেট ভর্তি ইনজেকশন রাখা থাকতো। নার্স ইনজেকশন পুশ করলে আমি চিৎকার থামাতাম। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে সামান্য ব্যথাতেই আমি প্রাণপণে চিৎকার দিয়ে হাসপাতাল কাঁপিয়ে তুলি। কয়েকদিনের মাথায় চিকিৎসক ব্যাপারটা ধরে ফেললেন। আধো ঘুম আধো জাগরণে আমি শুনতে পেলাম ডাক্তার বলছেন—‘এই ছেলেকে আর ‘প্যাথেডিন’ দেয়া যাবে না। ও তো এডিকটেড হয়ে যাচ্ছে!’
বোনাসের ঘটনাটা এই জীবনে কাউকে বলা হয়নি। আজকে বলি। ব্যথানাশক ইনজেকশন ‘প্যাথেডিন’ আমাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে রহস্যময় একটা ভুবনের দিকে নিয়ে যেতো। হাসপাতাল কেবিনে আমার ধবধবে শাদা বিছানাটা অজস্র বেলি আর শিউলি ফুলের সুরভিত একটা চাদর হয়ে উঠতো। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাদিনের চাদরের মতো সেই চাদরটা আমাকে নিয়ে উড়াল দিতো আকাশে। খুব দ্রুতই আমি পৌঁছে যেতাম অনেক দূরের ঝকঝকে একটা নীল আকাশে। তখন আমার ডানে বাঁয়ে মেঘ উড়ে যায় শরীর ছুঁয়ে। অনেক উঁচু থেকে পাখির চোখে আমি পাহাড় দেখি নদী দেখি সমুদ্র দেখি। উঁচু থেকে ঢাকা শহরের বিল্ডিংগুলোকে কখনো মনে হয় লেগো, কখনো মনে হয় ম্যাচ বাকশো আবার কখনো ডাস্টার। নদীগুলো যেনো আঁকাবাঁকা লম্বা রূপোলি ফিতে। নদীর বুকে পালতোলা নৌকোগুলোকে মনে হয় হাঁস। কিন্তু কোথাও কোনো মানুষ দেখি না। আসলে এতো উঁচু থেকে মানুষকে দেখা যায় না।
একদিন ওরকম ওড়াউড়ির সময় দেখি আমার পাশ দিয়ে উড়ে যায় শাদাশাড়ি পরা একটা পরী। পরীটার ডানা দুটোও ধবধবে শাদা পালকের। পরীটার কপালে লাল একটা টিপ। সেই টিপের সঙ্গে ম্যাচ করা লাল লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো পরীটাকে আমি চিনতে পারি। এই পরীটার নাম জয়শ্রী কবির। ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিতে এরকম শাদা শাড়ী আর লাল টিপ পরা পরীটাকে আমি দেখেছি। পরীটা গান গায়–বিমূর্ত এই রাত্রি আমার মৌনতার সূতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর…।
পরীটা আমার পাশাপাশি ওড়ে। তারপর কতো যে কথা বলে আমার সঙ্গে,পরীটা!
২
আমার সেই ‘প্যাথেডিনের’ নেশার কালে এক দুপুরে ২১ নাম্বার কেবিনে রোগী হিশেবে ভর্তি হলেন বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা রবিউল। ওয়ার্ডটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো। নার্স চিকিৎসকদের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখা গেলো। রবিউল বলে কথা।
রবিউলের সঙ্গে খুব ভাব জমে গেলো আমার। রাতে, সবাই যখন ঘুমিয়ে, পুরো হাসপাতাল যখন নিঝুমপুরী, তখন, মধ্যরাতে, হাসপাতালের বারান্দার ফ্লোরে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে চাঁদের আলোকে সঙ্গী করে আমি আর রবিউল ভাই মেতে উঠতাম তুমুল আড্ডায়। হু হু বাতাস চাঁদের আলোর সঙ্গে লুটোপুটি খেতে খেতে দুই জেনারেশনের অসম বয়েসী দু’জন মানুষের বন্ধুত্বকে প্রগাঢ় করে তুলতো। মধ্যরাতে শুরু হওয়া আড্ডা শেষ হতে হতে কখনো কখনো ভোর হয়ে যেতো।
প্রচণ্ড নেশা করতেন রবিউল ভাই। হাসপাতালে আসার নেপথ্য কারণ সেটাই। আমি আমার সাম্প্রতিক প্যাথেডিনান্দনের গল্প বলি। রবিউল ভাই পিঠ চাপড়ে দেন–শাবাশ। নেশাই যদি না থাকে তো এই জীবনে থাকে কি! তবে আঙ্কেল এখনই ঝাঁপ দিও না অকূল পাথারে। আরো বড় হও, তারপর। আগে নিজেকে দাঁড় করাও। (রবিউল ভাই কথা বলতেন খুবই বিশুদ্ধ উচ্চারণে।)
রবিউল ভাই নেশা করতেন এটা সকলেরই জানা ছিলো। পান করতে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু হাসপাতালে সেই সুযোগ ছিলো না তাঁর। কিন্তু তিনি ঠিকই হাসিল করে নিয়েছিলেন বিকল্প ব্যবস্থা।
এক রাতে আমরা গল্প করছি। আমার কথায় শিশুর মতো হেসে গুঁড়োগুঁড়ো হচ্ছেন রবিউল আঙ্কেল। এরই মধ্যে নাইট ডিউটিতে থাকা শাদা পোশাকে সজ্জিত এক তরুণী নার্স আমাদের অতিক্রম করে যাবার সময় অতি ক্ষিপ্র গতিতে রবিউলের হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে গেলো। রবিউল আঙ্কেলের চোখ-মুখ কী রকম উজ্জ্বল হয়ে উঠলো! তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন–তোকে খুব সুন্দর একটা বর জুটিয়ে দেবো রে…!(তাঁর মুঠোয় আবিস্কার করলাম একগুচ্ছ ট্যাবলেট!)
রোজ রাতে নানান বিষয়ে কথা হয় রবিউল আঙ্কেলের সঙ্গে। একদিনের আলোচ্য বিষয় ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’। দুঃখ করে বললেন তিনি–সাত ভাই চম্পা সিনেমায় মিউজিকের বিটে বিটে কান নাড়িয়ে ছিলাম আমি। খুব হিট হয়েছিলো তখন আমার সেই কান নাড়ানো। রাস্তাঘাটে লোকজন ধরতো–কান নাড়িয়ে দেখান। অনিচ্ছা থাকলেও দেখাতো হতো মাঝে মধ্যে। একবার তোমাদের বনগ্রামে আমার ছেলের বয়েসী একদল কিশোর আম্মাকে খুব অপদস্ত করলো। বখাটে সেই কিশোরেরা আমাকে কান নাড়াতে বলেছিলো খুব বেয়াদবের ভঙ্গিতে। নাড়াইনি আমি। আর তাই ওরা চড়াও হলো আমার ওপর! আম্মাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে প্রকাশ্যে রাস্তায় ওরা আমার কান ধরে টানাটানি করলো। অপমানে কাঁদছিলাম আমি। আর রাস্তায় জড়ো হওয়া একদঙ্গল মানুষ হাসছিলো! কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি! একজনও না! আমি যেনো আজব কোনো প্রাণি, চিড়িয়াখানার!
কথাগুলো বলতে বলতে সেই এতোকাল পরেও দ্বিতীয়বার অশ্রুসজল হয়েছিলেন আমার রবিউল আঙ্কেল!
বনগ্রামের সেই কিশোরদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছিলাম আমি।
কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিলেন তিনি–আমি ওদের সেই কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি…
–তবে যে কাঁদছেন?
–তাই তো! কেনো কাঁদছি আমি! আসলে তোমাকে ঘটনাটা বলতে গিয়ে অজান্তেই আবারও আমি ফিরে গিয়েছিলাম বনগ্রামের সেই রাস্তায়। সেই অপমানের মুহূর্তটা কী করে যেনো ফের সঞ্চারিত হলো একই রকম তীব্র যন্ত্রণাসহ। আমি আর কোনদিন কান নাড়াবো না……।
রবিউল আঙ্কেল কাঁদছেন। কাঁদছেন তিনি শিল্পের প্রতি মোহ মুক্তির
মিথ্যে ঘোষণা দিতে দিতে।
শিল্পের রহস্যটা এখানেই। অপমান না থাকলে, অশ্রু ঘাম আর রক্তের মিশ্রন না থাকলে শিল্প কখনো শিল্প হয়ে ওঠে না।
অনেক ভালো থাকবেন প্রিয় রবিউল ভাই, প্রিয় রবিউল আঙ্কেল!
অটোয়া, কানাডা