শুক্রবার - এপ্রিল ১৯ - ২০২৪

বিজলীর আলোয় জলের ক্রন্দন কাপ্তাই বাঁধ

লুসাই পাহাড়ে জন্ম নিয়ে শৈশবটা বেড়ে ওঠে কর্ণফুলির জলে। ভরা যৌবনা নদী হয়ে আত্ম সমর্পন করে বঙ্গোপসাগরে। পথে পড়ে পাড়ার বখাটে ছেলের শিস বাজানো কাপ্তাই বাঁধ। তাতে যেনো রূপ আরো উছলে পড়ে! স্ফীত জলে ঝলসানো রূপে রূপান্তরিত হয় সুন্দরী কাপ্তাই হ্রদ।
মানবসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ। টলটলে জলে আকাশের নীল ছায়া। পর্যটকের নীল চোখে দূরের সবুজ পাহাড়। কাপ্তাই হ্রদের জল আর আকাশের রঙ মিলে একাকার। এরি মাঝে কাপ্তাই হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রকল্প। কর্ণফুলির পেট চিড়ে সার্জারি করা মাটির বাঁধ। বাঁধে আটকানো কুমারী জল ফুঁসলিয়ে বানানো বিদ্যুত। প্রকৌশল সভ্যতায় নাম তাই জলবিদ্যুৎ। সিভিলাইজড ইংরেজি অনুবাদ হাইড্রোইলেক্ট্রিসিটি।
আজন্ম বিতর্কিত এ বাঁধ নিয়ে মানুষের আগ্রহ আর রাজনৈতিক সমালোচনার শেষ নেই। পাকিস্তানী শাসকদের ভুল রাজনীতি, পাহাড়ী জনগোষ্ঠির সাথে বৈষম্য আর ইউনিট প্রতি বিদ্যুত উৎপাদন খরচ বরাবরই সমালোচিত। স্বাধীন বাংলাদেশে জলবিদ্যুত প্রকল্প হাতে নেবার আগ্রহ বা সাহস আর কোনো সরকারেরই হয়নি। আইয়ুব আমলে কাপ্তাই বাঁধ ঘিরে পার্বত্য শান্তি ব্যাহত হবার যে সূচনা হয়েছিলো, সেখান থেকে শান্তির ধারায় ফিরতে লেগেছে বহু বছর।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বঙ্গভঙ্গ হয়েছে মাত্র। পূর্ববঙ্গ ও আসাম মিলে নতুন স্বতন্ত্র প্রদেশ। ঢাকা পেয়েছে রাজধানীর মর্যাদা। চট্টগ্রাম বৃহত্তম বন্দর নগরী। ১৯০৬ সালে কর্ণফুলীতে বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক সার্ভে শেষ হয়। পশ্চিমা বিশ্বে তখন বিদ্যুতের রমরমা ব্যবসা। থমাস আলভা এডিসনের বানানো বৈদ্যুতিক বাল্ব ঘরে জ্বলা মানে এক রাজকীয় ব্যাপার। আমেরিকা হুভার ড্যামসহ কয়েকটি জলবিদ্যুত প্রকল্প নিয়ে ভাবছে। সারা আমেরিকায় বিদ্যুতায়ন প্রক্রিয়া চলছে। ইংল্যান্ড, জার্মানি পিছিয়ে নেই। বাকিংহ্যাম প্যালেসে হ্যাজাকের বদলে বসানো হয়েছে ঝাড়বাতি।
এদিকে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের ভারতীয় প্রতিনিধিরা বিদ্যুতের আলো খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোলকাতা, দিল্লী, ঢাকায়। কিন্তু বিদ্যুত কোথায়? সেটার উৎপাদনই যে সর্বত্র শুরু হয়নি!
তবে সৌভাগ্যবান সেকালের কলিকাতা মহানগরী। বিদ্যুত সরবরাহের জন্য ১৯০৬ সালের মধ্যে তিন তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরী করা হয়েছিলো কোলকাতার আশেপাশে। ম্যাকিনন এন্ড ম্যাকেঞ্জি কটন মিলে পরীক্ষামূলক বিদ্যুত বাতি জ্বালানো হয় ২৪ জুলাই ১৮৭৯ সালে। এরপর উনবিংশ শতকের একেবারে শেষভাগে কোলকাতার ইমামবাগ লেনে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক স্ট্রিটলাইট লাগানো হয়। রাস্তার সামান্য অংশে। কেবল হুগলী নদীর প্রিন্সেপ ঘাট সংলগ্ন এলাকায়। ১৮৯৯ সালের কথা এটি। এছাড়া প্রায় একই সময় বোম্বের এক ট্রামলাইনে বিদ্যুত দিতে বৃটিশরাজ একটি জেনারেটর চালু করে।
পূর্ববঙ্গের দক্ষিন পূর্ব কোণায় কর্ণফুলি নদী। ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব সীমান্তে সর্বোচ্চ খরস্রোতা নদী। ইংরেজ প্রকৌশলীদের দৃষ্টি এড়ালোনা স্রোতের বেগ। মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ২৭০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। বিদ্যুত উৎপাদনে এটিই হতে পারে মোক্ষম জলের ধারা।
বঙ্গভঙ্গ রদ এবং নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্ববঙ্গ বিদ্যুতায়নে পিছিয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালে আবার কর্ণফুলি প্রকল্প সরকার বাহাদুরের নেক নজরে আসে। কিন্তু এরপর কেটে যায় আবার তেইশ বছর! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইংরেজদের বিদায় পর্বে ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা বরকল এলাকায় বাঁধ নির্মাণের পরামর্শ দেয়। পাকভারত স্বাধীনের পর ১৯৫০ সালে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশল পরামর্শক হিসাবে মার্জ রেন্ডাল কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স চিলারডাক এলাকায় বাঁধ স্থাপনের চূড়ান্ত পরামর্শ প্রদান করেন। এটি কাপ্তাই থেকে ৪৫ কিলোমিটার উজানে। তবে ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকারের সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী খাজা আজিমউদ্দিন রেন্ডালের নকশা থেকে বাঁধ সরিয়ে বর্তমান জায়গায় নিয়ে আসেন।
ভুলটা এখানেই হলো কিনা সেটি গবেষণার বিষয়। কাপ্তাই বাঁধ নিয়ে যতোটা গবেষণা হওয়া উচিত তা হয়তো হয়নি। তবে স্থান নির্বাচন যে সঠিক হয়নি সে ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞই একমত। বাঁধ নির্মাণের কারণে রিজার্ভার বা কৃত্রিম লেক তৈরী হলে বিপুল এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে প্রকৌশলীরা আগাম নকশায় তা বুঝতে পারেন। সেসকল এলাকা চিহ্নিত করে কতো পরিমাণ চাষযোগ্য ভূমি নষ্ট হবে সে ব্যাপারেও প্রকৌশলীরা আগাম রিপোর্ট তৈরী করেন। কতো জনপদ হারিয়ে যাবে, কতো মানুষকে উচ্ছেদ করা হবে সে হিসাব নকশা থেকেই বের করা যায়। স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং ফেডারেল শাসকদের দায়িত্ত্ব ক্ষতির পরিমান বুঝে প্রকৌশল পরামর্শ অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণে হাত দেয়া।
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এসব হিসেব না কষেই ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের আদেশ দেন। ইউটাহ ইন্টারন্যাশনাল নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্মান সংস্থার ব্যবস্থাপনায় বাঁধের কাজ শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান স্বশরীরে বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করেন। সামরিক ক্ষমতার জোরে স্থানীয় অধিবাসীদের দাবী অগ্রাহ্য করে দ্রুত কুচকাওয়াজে এগিয়ে যায় বাঁধ নির্মাণ। এতোবড় নির্মাণ যজ্ঞ ঐ আমলে মাত্র পাঁচ বছরেই সম্পন্ন হয়। প্রকৌশলগত দিক থেকে সাফল্যের কৃতিত্ব থাকলেও রাজনৈতিক ব্যর্থতা ফুটে ওঠে পুরো মাত্রায়।
পাকিস্তানের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি গুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। লক্ষ একর আবাদী জমি (জুম চাষ) বিনষ্ট আর লক্ষাধিক পাহাড়ী আদিবাসী মানুষ উদ্বাস্তু হয়। এর সত্তর শতাংশ চাকমা জনগোষ্ঠী। ৪০,০০০ পাকিস্তানী চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে আশ্রয় নেন। মজার ব্যাপার এই বাড়তি জনগোষ্ঠীর চাপ থাকা সত্ত্বেও কাপ্তাই বাঁধের বিন্দুমাত্র বিরোধীতা করেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। কারণ রাজনীতির জিলিপি তিনি খেয়েছেন জন্মলগ্ন থেকে। প্যাঁচটা আগেই আঁচ করেছিলেন। জানতেন চাকমা দ্রোহের আগুনে পাকিস্তানকে পুরতে হবে সারাজীবন। যদিও তা আংশিক সত্য হয়েছিলো। কেনোনা বাকি কষ্টের আগুনে পুড়তে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশকে।
বাষট্টি সালেই মোটামুটি নির্মাণ শেষ হয়। মূল বাঁধ মাটি দিয়ে নির্মিত। স্পিলওয়ে, পেনস্টক এবং ৪০ মেগাওয়াট কাপলান টারবাইন জেনারেটর বসানো শেষ হয় একই সময়কালে। মাটির বাঁধের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৬৭০ মিটার বা ২২০০ ফুট। চওড়া প্রায় ৪৬ মিটার বা ১৫০ ফুট। এর ভেতরেই রয়েছে ১৬ গেটের স্পিলওয়ে।
এটুকু করতে খরচের খাতা বেড়ে ৫০৩ মিলিয়ন রুপিতে ওঠে। অর্থ যুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ওভারসিজ ইকোনোমিক কো-অপারেশন ফান্ড এবং ইষ্ট পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার। চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো কেন্দ্রীয় সরকার কোনো অর্থ দেয়নি।
দীর্ঘদিন উৎপাদন ক্ষমতা আর বাড়েনি। ১৯৮২ সালে ৫০ মেগাওয়াট এবং ১৯৮৮ সালে আরো ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা বাড়ানো হয়। বর্তমানে এতোবড় প্রকল্পে উৎপাদন মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট।
যেকোনো হাইড্রোইলেক্ট্রিক বাঁধ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুত উৎপাদনের পাশাপাশি আবাদী জমিতে জল সরবরাহ করা। কিন্তু কাপ্তাই বাঁধের কল্যাণে কৃষিতে সাফল্য আসেনি। বরং বিনষ্ট হয়েছে ২৪০ বর্গকিলোমিটার আবাদী জমি। যা সমগ্র মালদ্বীপের আয়তনের প্রায় আশি শতাংশ।

- Advertisement -

ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent