শুক্রবার - এপ্রিল ২৬ - ২০২৪

দুই পয়সার শৈশব

ছবিআনাসটাশিয়া চেরভিনসকা

খুব অল্পেই খুশি হতে পারি আমি। সামান্য বিষয়ে মুগ্ধ হবার শক্তি আমার আছে। সামান্য আদর-ভালোবাসায় গলে যাই। অতিসামান্য অবহেলায় কষ্ট পাই। মুগ্ধ হবার জন্যে খুব বড়সড় গোলাপ কিংবা সূর্যমুখী লাগে না আমার। একটা সামান্য ঘাসফুলও আমাকে ভাসিয়ে নিতে পারে মুগ্ধতার প্লাবনে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে একবার তীরবর্তী বালুকাসমাবেশে অনাদর অযত্নে বিস্তার লাভ করা খুদে খুদে সবুজ পাতার সমারোহে অপরূপ সুন্দর খুবই ছোট আকারের কিছু ফুল দেখেছিলাম। তার বেগুনি-শাদার রঙের বিস্তারে ছিলো শিমফুলের খানিক আভাস। অথবা বলা যেতে পারে কচুরিফুলের রঙের প্রতিধ্বনি যেনো বা। সেন্টমার্টিন দ্বীপে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কিশোর ছেলেটা, যে আমার গাইডের দায়িত্ব নিয়েছিলো সেচ্ছায়, সামান্য ছোট্ট একটা ফুল দেখে আমার অপার বিস্ময়ে নিজেই বিস্মিত হয়ে বলেছিলো–স্যার এই ফুলের নাম ‘গাঙ ফুল’। এইটা কুনু দামি ফুল না।

ছেলেবেলায় ওয়ারির মুচিপাড়া-উত্তরমৈশুন্ডি-যোগীনগর-বনগ্রাম লাগোয়া আমাদের মহল্লায় একজন আইসক্রিমওয়ালা আসতো। তার হাতে থাকতো বড়সড় ফ্লাস্ক ধরনের একটা বাকশো। ওটার ভেতরে থরে থরে সাজানো থাকতো আইসক্রিম। বাকশোর ওপরে লেখা থাকতো কোম্পানির নাম–ম্যাঙ্গোলিয়া। আইসক্রিমওয়ালা একটা নির্দিষ্ট সুরে উচ্চকন্ঠে একটা বাক্যই বলতো অবিরাম–‘ম্যাঙ্গোলিয়া গিয়া। দুই আনা এক আনা দুই পয়স্যা।’ ম্যাঙ্গোলিয়ার পর গিয়া শব্দটা কেনো বলতো বুঝতাম না। আর দুই পয়সা শব্দটার দন্ত স কে ডাবল করে নিয়ে সে বলতো ‘দুই পয়স্‌সা’। অর্থাৎ মোট তিন ধরণের আইস্ক্রিম ছিলো তার ভান্ডারে। যাদের বিনিময় মূল্য যথাক্রমে দু’আনা, এক আনা এবং দু’পয়সা।

- Advertisement -

দুই পয়সা দামের আইস্ক্রিমটা ছিলো পুরোটাই কাঠিওলা মিষ্টি রঙিনবরফের একটা টুকরো বিশেষ। কঠিন শক্ত। কামড়ে খেলে দাঁতের খবর হয়ে যেতো। তবে সেই বরফ গলতে সময় নিতো। ফলে সেটা ফুরিয়ে যেতে টাইম লাগতো বেশ। এক আনা দামেরটা ছিলো খানিকটা নরম। হালকা কামড় দিলে কাঠি থেকে ভেঙে আসতো আলতো করে। স্বাদেও একটু বনেদি বনেদি ভাব। আর দু’আনা দামেরটা ছিলো একদম অভিজাত শ্রেণীর। ওটাকে বলা হতো মালাই আইস্ক্রিম। দুধের তৈরি। অপরূপ শুভ্রতা মাখানো দুধশাদা রঙের। ওতে বরফ থাকতো কম। ওটা গলে যেতো দ্রুত। কিন্তু ওটার স্বাদ ছিলো ঈর্ষণীয়। দুর্ধর্ষরকমের সুস্বাদু। এই মালাই আইস্ক্রিমটা ছিলো আমার নাগালের বাইরে। মধ্যবিত্ত পরিবারে একগাদা ভাইবোনের কিলবিলে সংসারে আমার পকেটের সাধ্যের সীমানায় কেবল দুই পয়সার আইস্ক্রিমটাই জুটতো। বড়লোক বন্ধুরা খেতো দুই আনা দামের দামি মালাই আইস্ক্রিম। ওদের ঠোঁটের ওপরে শাদা মালাইয়ের একটা প্রলেপ লেগে থাকতো। জিভ দিয়ে ওরা সেটুকুওখেয়ে নিতো। আমারও খুব ইচ্ছে করতো দুই আনা দামের আইস্ক্রিম খেতে। কিন্তু পকেট সেটা এলাও করতো না। আমি কি খুব দুঃখ পেতাম? কষ্ট পেতাম?

পেতাম তো বটেই, খানিকটা। কিন্তু সেই কষ্ট আর দুঃখকে পাত্তা না দিয়ে বরং আমার সাধ্যের দুই পয়সার আইসক্রিমেই আমি সন্তুষ্ট থাকতে শিখে গিয়েছিলাম। কি করে শিখেছিলাম জানি না। দুই পয়সার কাঠিওয়ালা সবুজ-কমলা-হলুদ আর লাল বরফের টুকরোগুলো আমাকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট ছিলো। আমি মেনে নিয়েছিলাম মালাই আইস্ক্রিম আমার জন্যে নয়।

আমি মেনে নিয়েছিলাম আমার শৈশব দুই আনার নয়, আমার শৈশব দুই পয়সার।

সেই দুই পয়সার শৈশবের আমার স্কুল জীবনটা কেটে গেছে বছরে দুইটা শার্ট আর দুইটা প্যান্টেই। মাপে টিকলে এক জোড়া জুতো বা স্যান্ডেলেই পার করে দিতাম কয়েক বছর। আমার পায়ের সাইজছিলো ছোট। ফলে নতুন জুতো বা স্যান্ডেল জুটতো কম। অন্যদের জুতো-স্যান্ডেল ‘ছোট’ হয়ে যেতো। কিন্তু আমারটা ‘ছোট’ই হতো না! ফলে একজোড়া স্যান্ডেল-জুতোতেই পেরিয়ে যেতো দিন।

নতুন জামা কাপড় পেতাম কেবল ঈদে। সেটারও ছিলো রেশনিং ব্যবস্থা। রোজার ঈদে জামা পেলে কোরবানী ঈদে পেতাম না টাইপের। স্বাধীনতার পর পর সদরঘাটের ফুটপাথে একটা নতুন ব্যবসা শুরু হলো। পুরনো ব্যবহৃত বিদেশী জামা-প্যান্টের একটা মার্কেটই চালু হয়ে গেলো। মার্কেটের নাম ‘ল্যান্ডি মার্কেট’। সেই ল্যান্ডি মার্কেটে পাওয়া যেতো দারুণ দারুণ রঙ নকশা আর হালকা নরোম জামা-কাপড়। সেই ল্যান্ডি মার্কেট থেকে কেনা বিদেশী ব্যবহৃত পুরনো একটা জামা-প্যান্ট পেলেই বর্তে যেতাম। আহারে আমার দুই পয়সার শৈশবের জীবন!

ব্রান্ডনেম বিহীন কমদামি জামাকাপড় এবং পারফিউমে আমার চলে যায়। ব্রান্ডনেম কখনোই টানে না আমাকে। পোশাকটা জুতোটা পারফিউমটা খুব দামি হবার দরকার নেই, চমৎকার হলেই হলো। নিজের জামা-জুতো-জ্যাকেট-পারফিউম আমি নিজে কিনি না। ওসব কিনতে পারি না আমি। সব শার্লি কিনে দেয়। ‘সেল’-এর সময় এই মল সেই মল ঘুরে ঘুরে শার্লি কিনে আনে চমৎকার সব জামা-জুতো-জ্যাকেট আর পারফিউম। সবক’টাই বিখ্যাত ব্রান্ডের। কিন্তু একটা ব্রান্ডও চিনি না আমি। মাঝে মধ্যে কপট রাগে ক্ষিপ্ত হয় শার্লি–তোর জন্যে এইসব বিখ্যাত ব্রান্ডের জিনিস কিনি খামোখা। এইসবে যোগ্য তুই না। এইসবের মূল্য তুই বুঝিস না একটুও।

হ্যাঁ। এইসবের যোগ্য আমি হতেও চাই নি কোনোদিন।

আমার দুই পয়সার শৈশব আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে।

কানাডায় এসে দশ ডলার দামের হাত-ঘড়িতেই আমার চলে যেতো। দশ ডলারের বেশি দামি ঘড়ি আমি কিনতামই না। ঘড়ির ব্যাটারি পাল্টাতে লাগতো দশ ডলার। তাই ব্যাটারি না পালটে ছয় সাত মাস পর পর নতুন ঘড়ি কিনতাম। আমার কন্যা নদী যখন কার্লটন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। আমার কমদামি ঘড়ি ওর খুব অপছন্দের ছিলো তখন। উইকএন্ডে কাজ করে কিছু আয় হতো তার। সেই আয় থেকে এক জন্মদিনে সে আমাকে একটাঘড়ি প্রেজেন্ট করলো। চমৎকার একটা টিনের বাকশে থাকা ঘড়িটার নাম ‘ফসিল’। আমি তখনও জানি না ফসিল কি। আমার পুরনো কমদামি ঘড়িটা সে গায়েব করে দিলো যাতে ওর দেয়া ঘড়িটাই পরি আমি। একদিন সেই ঘড়ি হাতে আমি অটোয়ার বিখ্যাত একটা মল-এর ঘড়ির দোকানে গিয়ে কাঁচঘেরা সারফেসের ভেতর খুঁজে বের করলাম একই রকম আরেকটা ঘড়িকে। দেখি ওটার দাম লেখা একশো আশি ডলার! কোনো মানে হয়! আমার দশ ডলার দামের ঘড়ির চাইতে একটুও বেশি সময় এটা দেয় না!

এখনও আমার হাতে শোভা পায় নদীর দেয়া সেই ‘ফসিল’ ঘড়িটাই।

আমার সেই দুই পয়সার শৈশবে অনেক মার্বেল ছিলো। চকচকে মার্বেল। আমি মার্বেল খেলতাম। পুরোন ঢাকায় মার্বেলকে আমরা বলতাম–গুল্লি। সেই অর্থে মার্বেল না বলে গুল্লি খেলতাম বলাটাই ভালো। মার্বেল বা গুল্লি কিনতাম সস্তার মুদি দোকান থেকে। যেখানে এক ডজন মার্বেল পাওয়া যেতো এক আনায়। সেই মার্বেলগুলো হতো খুবই মামুলি ধরনের। ট্রান্সপারেন্ট কাঁচের ভেতরে অনুজ্জ্বল রঙের নকশা। আমার হাফপ্যান্টের পকেটভর্তি মার্বেলগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কী অদ্ভুত রকমের একটা সিম্ফনি তৈরি করতো! এই গুল্লি বা মার্বেলকে কেউ কেউ ‘বিড়িং’ও বলতো।

যোগীনগর মোড়ে ছোট্ট একটা দোকান ছিলো। দোকানটায় বসতো এক অবাঙালি। বিহারী তরুণ। আমরা বলতাম মাউরা। ওর চোখের মনিটি ছিলো ব্রাউন। খুব হাসিখুশি ছিলো কিন্তু ছিলো খুব কঠিন। দাম কমাতে চাইতো না সে শতো অনুনয়েও। ওর দোকানে একটা বয়ামে কিছু স্বপ্নের মার্বেল ছিলো। ঢাকা শহরে আর কোনো দোকানে ওরকম দুর্দান্ত কালারের মার্বেল পাওয়া যেতো না।

ওর মার্বেলগুলো ছিলো একরঙা। ফিরোজা, হালকা হলুদ, হালকা বেগুনি, কিংবা আকাশী নীল রঙের একরঙা একটা মার্বেলই বিক্রি করতো সে দুই আনায়! একটা কিনেছিলাম ফিরোজা রঙের, কামরাঙি নকশার। ওইটা

ছিলো আমার সবচে প্রিয় ‘ডাজ্ঞি’। একটু বড় সাইজের মার্বেলকে বলা হতো ডাজ্ঞি।হাফপ্যান্টের পকেটেই থাকতো ওটা। একটু পর পর ওটাকে দেখতাম পকেট থেকে বের করে করে। আমার দুই পয়সার শৈশবে সেই দুই আনার মার্বেলটা ছিলো আমার খুব দামি সম্পদের মতো।

আমি কল্পনা করতাম–একদিন বড় হয়ে মাউরার বয়ামের সবক’টা ঝকঝকে দুর্দান্ত একরঙা মার্বেল আমি কিনে নেবো।

ডাজ্ঞির বিপরীতে আরেকটা মার্বেলকে বলা হতো চুঁই। সবচে খুদে বা পিচ্চি মার্বেলের নাম ছিলো চুঁই।

দুই পয়সার শৈশব আমাকে জীবন চিনিয়েছে। দুই পয়সার শৈশবই আমাকে শিখিয়েছিলো সিম্পল ইজ গুড। স্মল ইজ বিউটিফুল। অল্পতে খুশি হওয়া আর সামান্যতেই মুগ্ধ হবার শিক্ষাটা দুইপয়সার শৈশবের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম আমি।

যে কারণে কানাডা থেকে ঢাকায় গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে চুনকাম আর পলেস্তারা খসে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের পাশে জাজিম পাতা ফ্লোরেই খুব অনায়াসে আমি ঘুমুতে পেরেছি দিনের পর দিন। দামি এপার্টমেন্টের পরিপাটি কক্ষের আরামদায়ক বিছানার অভিজ্ঞতা থাকা জীবনে সোফায় ঘুমানো কিংবা জাজিম পাতা ফ্লোরে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা থাকাটাও জরুরি। শেরাটন কিংবা সোনার গাঁও কিংবা ওয়েস্টিনে খাওয়ার চাইতে ‘গোল্ডেন চিমনি’তে খাওয়াটা আমার কাছে বেশি আনন্দের মনে হয়। ঢাকায় গেলে বন্ধুরা খাওয়াতে চায় দামি রেস্টুরেন্টে নিদেন পক্ষে ‘তড়কা’য়। কিন্তু আমার পছন্দ ‘স্টার কাবাবের’ মোরগ পোলাও। কম দামি। কিন্তু স্বাদে-গন্ধে সেরা। যে গন্ধে আমার দুই পয়সার শৈশবের সৌরভ লেগে আছে।

এবার ঢাকায় প্রতি বিকেলে চ্যানেল আইয়ের ছাদ ক্যান্টিনে আমার প্রতিদিনের চায়ের আসরে প্রায় প্রতিদিন সঙ্গী হিশেবে পেয়েছি নিউজের সারওয়ার-উল-ইসলামকে। সে আমাকে ভীষণ চমকে দিয়েছিলো একদিন। তার এলাকা মিরপুরের কোনো এক বেকারি থেকে আমার জন্যে সে নিয়ে এসেছিলো এক প্যাকেট ‘ক্রিম রোল’। জোর গলায় দাবি করেছিলো–খাইয়া দেখেন। সেইরকম টেস্ট।

ওটায় কামড় বসিয়ে ছেলেবেলার মতো খুশি হয়ে উঠেছিলাম।

আহা! ষাট বছর বয়েসে দুই পয়সার শৈশবের ঘ্রাণ!

তুমি ভালো থেকো ছেলেবেলা।

তোমাকে আমি বুড়ো হতে দেবো না।

- Advertisement -

Read More

Recent