বৃহস্পতিবার - এপ্রিল ২৫ - ২০২৪

অন্ধ বসন্ত

গাছের উপরে আকাশ। আকাশের উপরে জমাট বাতাস, তার উপর অন্ধকার। সেখান থেকে সুরঙ্গ বেয়ে ধুপ করে পড়ল একটি ছেলে। ছেলেটি ঘুরেফিরে এসে দাঁড়াল মেয়েটির বাড়ির সামনে। সবার মুখে প্রশ্ন ঝুলে আছে ছেলেটি এলো কোথা থেকে!
নানা রকম ফল ফুল লতা পাতা জড়ানো ছেলেটির দেহে। মেয়েটি তখনও রাতের ঘুমে আচ্ছন্ন। ইচ্ছে হলে উঠতে পারতো। কিন্তু সারারাত টিক-টক করেছে তাই নয়টা অব্ধি ঘুমিয়ে আছে।
লোকমুখে শোনা গেল ছেলেটি একটি রাজপুত্র। সে লম্বায় বেশি কিন্তু পাশে কম। পেটের ওপর সিক্সপ্যাক ভাঁজ। হাসে ঠিক টমবয়দের মত। চুল কোঁকড়ানো, যেন সরাসরি এডাম পরিবারের কেউ। তার হাতে একটি রক্ত গোলাপ। গোলাপের কাঁটা লেগে তর্জনী গড়িয়ে রক্ত পড়ছে।
ছেলেটি কোন ভাষায় কথা বলে বোঝা যাচ্ছে না। কেননা ছেলেটি কোন কথা বলছে না। অনেকে ভাবছে দূর থেকে একটা ঘোড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে কিন্তু কোথাও ঘোড়া দেখতে পাচ্ছে না কেউ। এমনকি ঘোড়ার গায়ের তীব্র গন্ধটি পর্যন্ত নেই। ঘোড়া মেয়ে হোক কিংবা পুরুষ গন্ধ সেই একটাই। ঘোড়ার গন্ধ।
কী হয় না হয় তা দেখার জন্য গলির সবগুলো জানালা ভরে গেছে হেজাবে। পথের ওপরে কিলবিল করছে পায়ের মিছিল। তবুও মাছি উড়লে ভন ভন শব্দ শোনা যাবে এতোটাই নীরবতা চারিদিকে।
মনে হলো মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। কেননা ছেলেটি এইমাত্র সেন্টু কমিশনারের পাকা করা রাস্তার ওপর হাঁটু ভেঙ্গে দোতালার বারান্দার দিকে গোলাপ উঁচিয়ে ধরেছে।
মেয়েটির নাম হাওয়া বেগম। দুষ্টু ছেলেরা তাকে ডাকে এয়া-রি। এয়া-রি বেগম। প্রতি রাতে সাদা নাইটি পরে ঘুমায়। ঘুমের মধ্যে একগাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে থাকলে ওর নাকি হাঁসফাঁস লাগে। কাজেই সাদা এবং হাল্কা নাইটি পরে ঘুমায় সে। আরও একটি কারণ আছে। সে মনে করে সাদা ফিনফিনে কাপড় পরে ঘুমলে যেকোনো দিন তার স্বপ্ন সত্য হয়ে যেতে পারে।
বারান্দার সাথে লাগোয়া বেডরুমের দরজা। সেই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। দোতালার বারান্দা তাই নাইটি পরে দাঁড়ানো নিয়ে অতশত ভাবে না। সময় সকাল নয়টা বেজে বিশ মিনিট। ওর হাতে পেস্ট লাগানো গোলাপি টুথব্রাশ। ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে যাবার আগে সে ফেরিওয়ালাদের সাথে নিয়মিত কথা বলে। এভাবেই শুরু হয় তার দিন। মোহাম্মদপুর বাজারের খুব কাছে হাওয়াদের বাসা তবুও অনেক ফেরিওয়ালা গলিতে ঢুকে শাকসবজি মাছ মুরগি বিক্রি করে। সে কারণে বাজারে যাওয়ার ঝামেলা থেকে অনেকে বেঁচে যায়। মেয়েটি কোন কিছু কেনে না তবুও একে-ওকে ডেকে দামদর জিজ্ঞেস করে। আজ প্রথমেই জিজ্ঞেস করল। ‘মামা মুরগি কি ডিম পারে না বাচ্চা মুরগী?’ ‘জোড়া কত?’
এরপর মাছওলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মাছে কি ফরমালিন দিছেন মামা?’
মুরগিওয়ালা দাঁড়িয়ে কথা বললেও মাছওয়ালা ওর কথাতে দাঁড়ায় না। কিছু কিনেকাটে না তবুও একদিন ফরমালিন নিয়ে লম্বা বক্তৃতা দেওয়াতে মাছওয়ালা ওকে তেমন পছন্দ করে না। ব্যাপারটা হাওয়া বুঝতে পারে। তবুও মামা সম্বোধন করে তাদের সাথে কথা বলতে ওর ভালো লাগে।
শুরু হয়ে গেল সকালের নিয়মিত রুটিন। অন্দরমহলের ঘণ্টা বেজে উঠল। ‘এই হাওয়া তুই কি বাথরুমে যাবি? তোর আব্বা সেই কখন থেকে বসে আছে। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে না?’
বাড়িতে ওয়ান এন্ড হাফ বাথরুম থাকলে যা হয় আর কি।
হাওয়া বুঝতে পারে এখনি তাকে বাথরুমে ঢুকতে হবে, না হলে ওর বাবাও খেপে যাবে। চলে যাবার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি আকাশে কোন সুড়ঙ্গ আছে কিনা। আরো দেখে রাস্তার কোথাও পড়ে আছে কিনা কোন গোলাপ পাপড়ি।
কেমন করে থাকবে এসব! স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে স্বপনের রাজপুত্র পালিয়ে যায়। তবুও তার মন ভালো থাকে। সে কোন আক্ষেপ করে না।
হুট করে টুথপেস্ট থেকে ঘোড়ার গন্ধ এসে লাগে নাকে। নাকের কাছে সে টুথব্রাশ টেনে নেয়। কিছুটা টুথপেস্ট তাতে লেগে যায় নাকে। ওর মা দ্বিতীয়বার হাওয়া বলে ডাকতেই নাকের দিকে তাকিয়ে ট্যারা চোখে দৌড় দেয় বাথরুমে।
বাথরুমের ঢুকে প্রথমেই চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে। ঘোড়াটি যেন ধবধবে সাদা হয়। আর রাজপুত্র যেন হয় এডামের মত হাওয়া পাগল মানুষ। ভুল করে চোখ খুলে ফেলেছিল। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে আবার প্রার্থনা করে, অনেক বেশি যেন দেরি না হয়।
অনেক আদরের মধ্যে থেকেও মানুষ বিশেষ একটি ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করে। এই মেয়েটি এখন সেই অপেক্ষার দলে। ভালোবাসার জন্য পাগল – এমন মানুষের সব প্রার্থনা ঋতুরাজের কাছে।

- Advertisement -

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent