বুধবার - এপ্রিল ১৭ - ২০২৪

আমার বিটিভি এবং একজন মানিক মিয়া সরকার

ছবি ক্লে ব্যাংকস

আর নিতে পারছি না। করোনা কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রিয় মানুষকে। এ যেনো মৃত্যুর অনন্ত মিছিল। করোনা ছাড়াও নানান অসুখ-বিসুখে এই মৃত্যুমিছিলে শামিল হচ্ছেন একজীবনের ঘনিষ্ঠ এবং পরিচিতজনেরা। কিছুক্ষণ আগে বিটিভির সাবেক জেনারেল ম্যানেজার কামরুন্নেসা হাসানের ফেসবুক স্ট্যাটাস সূত্রে জানতে পারলাম আরেকজন প্রিয় মানুষের প্রস্থানের দুঃসংবাদ। তিনি মানিক মিয়া সরকার। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সোনালি যুগের অনুষ্ঠানমালার মেধাবী চিত্রগ্রাহক।

একটা সময়ে বাংলাদেশে বিটিভিই ছিলো একমাত্র টিভি চ্যানেল। বিটিভির দর্শক ছিলেন যাঁরা,তাঁরা অনুষ্ঠান শেষে টেলপে প্রদর্শিত কলাকুশলীদের নাম পর্যন্ত জানতেন। প্রতিদিন শাদা কালো পর্দায় অনিন্দ্যসুন্দর শাদা হস্তাক্ষরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো নামগুলো। মুস্তাফা মনোয়ার-আবদুল্লাহ আল মামুন-আতিকুল হক চৌধুরী-জিয়া আনসারী-মুস্তাফিজুর রহমান-নওয়াজীশ আলী খান-মোস্তফা কামাল সৈয়দ-কামরুন্নেসা হাসান-শাহিদা আরবী-সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন,কাজী কাইয়ুম,মুসা আহমেদ, আলীমুজ্জামান,আলী ইমাম-রিয়াজউদ্দিন বাদশা-ফখরুল আবেদিন দুলাল-ফিরোজ মাহমুদ-হাবীব আহসান প্রমুখ নামের প্রযোজকদের পাশাপাশি রূপসজ্জায় উত্তম-মোয়াজ্জেম-ফারুক-সেন্টু, ব্যবস্থাপনা রুস্তম আলী,সেট ডিজাইন বা শিল্পনির্দেশনায় আনোয়ার হোসেন-মহিউদ্দিনফারুক-কেরামত মাওলা, সঙ্গীত পরিচালনা ও সুরসংযোজনায় খোন্দকার নূরুল আলম-জালাল আহমেদ-মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ-আনিসুর রহমান তনু, ক্যালিগ্রাফিতে মাহতাব উদ্দিন আহমেদ-মানিক দে, চিত্রগ্রহণে গোলাম মোস্তফা-সৈয়দ মাহমুদ আহমেদ- মুহম্মদ ইদ্রিস-মানিক মিয়া সরকার-সমীর কুশারীর নামগুলো স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বলে। সেই তালিকার মানিক মিয়া সরকার আজ চলে গেছেন জীবনের সমস্ত হিশেব চুকিয়ে।

- Advertisement -

একটা সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনই হয়ে উঠেছিলো আমার অঘোষিত কর্মস্থল। আমি বিটিভিতে চাকরি করতাম না কিন্তু প্রতিদিন সকালে আমি বিটিভি ভবনে যেতাম এবং ফিরতাম বিকেলে, চাকরিজীবী প্রযোজক কলাকুশলীদের মতোই।

দুপুরে লাঞ্চ করতাম বিটিভি ক্যান্টিনে। আমার রচনা ও নির্দেশনায় ‘ঝন্টু-পন্টু’ এবং ‘হইচই’ নামের ছোটদের দুইটা সিরিজ নাটক প্রচারের সময় রিহার্সাল এবং রেকর্ডিং-এর কারণে কখনো কখনো বাড়ি ফিরতাম রাত এগারোটার পর।

এছাড়াও ঈদ-পার্বণে ছোটদের বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান রচনা ও পরিচালনা,বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা কিংবা স্ক্রিপ্ট লেখা গান লেখা অথবা নতুন কুঁড়ির গ্রন্থনা ও নির্দেশনা জনিত কারণে দিনমান আমাকে অবস্থান করতে হতো বিটিভি ভবনেই। সেই কারণে বিটিভিতে চাকরিতে নিয়োজিত সকল শাখার সমস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে তৈরি হয়েছিলো আমার দারুণ একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ আন্তরিক সম্পর্ক। আমি হয়ে উঠেছিলাম বিটিভি পরিবারেরই একজন সক্রিয় সদস্য।

বিভিন্ন প্রযোজকের সঙ্গে নানান অনুষ্ঠানে আমার এরকম যুক্ত থাকার অলিখিত একটা নাম ছিলো–খ্যাপ মারা। হ্যাঁ, বাড়তি কিছু টাকা উপার্জনের প্রয়োজনেই আমাকে নিয়মিত শ্রম দিতে হতো প্রচুর। বিনিময়ে মাস শেষে চার-পাঁচটা চেক পাওয়া যেতো যে চেকগুলো একসঙ্গে একাউন্টে জমা দিলে প্রতিমাসে গড়ে তিন-চার হাজার টাকা হাতে আসতো। পত্রিকায় চাকরির স্যালারির সঙ্গে সেই টাকাটা যুক্ত হয়ে আমার সংসারকে অর্থনৈতিক টানপড়েন থেকে বাঁচিয়ে খুবই স্বস্তিতে রাখতো। সেই কারণে বিটিভির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আমি নিজেকে বিটিভির প্রোডাক্ট বলেই মনে করি। কৈশোর যৌবনে আমার যৎসামান্য পরিচিতি এবং খ্যাতির পেছনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলো বিটিভি অর্থাৎ বাংলাদেশ টেলিভিশন।

বিটিভির সঙ্গে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৭২ সালে,একজন শিশুশিল্পী হিশেবে। ছোটদের অনুষ্ঠানে আমার গান গাওয়া, অভিনয় করা, আবৃত্তি-উপস্থাপনা কিংবা ছবি আঁকা কোনো কিছুই বাদ যেতো না। বিটিভি ভবনটি তখন ছিলো বঙ্গভবনের পাশে ঘড়িওয়ালা বিখ্যাত ডিআইটি বিল্ডিং-এ। বিটিভি রামপুরায় গেছে অনেক পরে।

রামপুরায় বিশাল ভবনে যাবার পর তিনটি স্টুডিওতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ক্যামেরার সামনে এবং ক্যামেরার পেছনে তৎপর থাকার কারণে চিত্রগ্রাহক বা ক্যামেরাপার্সনদের সঙ্গে এবং তাঁদের খুদে এসিস্ট্যান্টদের সঙ্গেও আমার গড়ে উঠেছিলো অপরূপ সখ্য।

তখন বিটিভি ছিলো একটা একান্নবর্তী পরিবারের মতো। আমরা যাঁরা বাইরে থেকে অনুষ্ঠান করতে যেতাম তাঁরাও সেই পরিবারের একজন সদস্যের মর্যাদাই পেতাম। খুবই আন্তরিক একটা পরিবেশ ছিলো তখন। প্রযোজক-নির্দেশক-চিত্রগ্রাহক-স্ক্রিপ্ট রাইটার-উপস্থাপক মিলে মায়ামমতায় জড়াজড়ি করা অপূর্ব একটা সম্পর্ক তখন পরিলক্ষিত হতো। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি উদাহরণ হিশেবে।

সময়কাল আশির দশকের মাঝামাঝি।

সেদিন বিটিভিতে একটা রেকর্ডিং-এ আমার অংশ গ্রহণ ছিলো। একটি অনুষ্ঠানের বিশেষ সেগমেন্টে একটা বইয়ের ওপর আমার আলোচনা। বইটা সঙ্গে নিয়ে আমি বিটিভি ভবনে গেছি। প্রযোজকের সঙ্গে আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলো পরিকল্পটা যে–আমি যখন বইটি সম্পর্কে বলবো তখন আমার ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে পুরো পর্দা জুড়ে সেই বইটির প্রচ্ছদের একটা স্টিল ফটোগ্রাফি। সেই স্টিল ফটোগ্রাফির ভেতরেই ভেসে উঠবে আমার মিডশটের অবয়ব। ক্রোমা পদ্ধতিতে কাজটা করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতির ব্যবহারের জন্যে আর্টিস্টের পেছনে থাকে বড়সড় একটা নীল পর্দা। সেদিন বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় ক্রোমা পদ্ধতির কথাটি বেমালুম ভুলে গিয়ে গাঢ় নীল রঙের সুন্দর একটা চেক শার্ট পরে বেরুলাম। স্টুডিওতে নীল চেক শার্ট পরে নীল ব্যাকগ্রাউন্ডকে পেছনে রেখে একটা রস্ট্রামের সামনে দাঁড়িয়েছি আমি। ক্যামেরা অন হলো। মনিটরে ভেসে উঠলো আমার স্কন্ধকাটা একটা মাথা। মাথার সঙ্গে শরীরটা নেই। স্টুডিওতে হাসির হুল্লোড়। প্রডিউসার অর্থাৎ প্রযোজক দোতলায় তাঁর প্যানেলে বসে টকব্যাকে হায়হায় করে উঠলেন–রিটন তুমি করেছো কী! খুঁজে খুঁজে নীল শার্টটাই পরে এলে আজকে!

আমার আইটেমটাই ছিলো সেদিনের রেকর্ডিং-এর সর্বশেষ আইটেম। এরপর লাঞ্চ ব্রেকে যাবেন সবাই। আমার কারণে লাঞ্চ ব্রেক বিলম্বিত হতে যাচ্ছে। সবাই উসখুস করছেন অস্বস্তিতে। এমন সময় স্টুডিও ভর্তি লোকের সামনে আমাকে কপট রাগে গালাগাল দিতে দিতে ক্যামেরার পেছন থেকে এগিয়ে এলেন চিত্রগ্রাহক মানিক মিয়া সরকার–‘লিটল্‌ (তিনি আমাকে লিটল্‌ বলতেন) তুমি আর মানুষ হইলা না! এতোদিন ধইরা টিভিতে কাজ কইরা এই শিখলা!’ বলতে বলতে নিজের ডিপ চকোলেট রঙের ফুলস্লিভ শার্টটি পটাপট খুলে ফেললেন মানিক ভাই। তারপর আমাকে বললেন জলদি পর মিয়া। লাঞ্চ ব্রেকের দেরি হইতাছে কিন্তু!

স্টুডিও ভর্তি লোকের সামনে আমি আমার নীল শার্টটা খুলে ফেলে মানিক ভাইয়ের শার্টটা গায়ে চাপালাম। তিনি আমার চে ঢের লম্বা। তাই হাতা গুটিয়ে নিলাম দ্রুত। মানিক ভাই নিজ হাতে আমার শার্টের বোতাম কলার এবং সোল্ডার টেনেটুনে ঠিকঠাক করে আমাকে সঠিক পজিশনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন–‘লিটল্‌ মিয়া তোমার শার্ট লম্বা হইয়া ঝুলতাছে তাতে অসুবিধা নাই। আমি ক্লোজেই তোমারে ধরমু।’

এরপর ধবধবে ফর্সা উদোম শরীরে ভয়াবহ হিমশীতল স্টুডিওতে প্রায় কাঁপতে কাঁপতেই ধারণ করলেন তিনি আমার উপস্থাপনার অংশটি।

সেদিনের ঘটনাটা বিটিভির ইতিহাসে শিল্পী এবং কলাকুশলীদের পারষ্পরিক মায়ামমতা সৌহার্দ্য ভালোবাসা আর প্রফেশনালিজমের অনন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকলো। সেই মানিক ভাই, বিটিভির মেধাবী চিত্রগ্রাহক মানিক মিয়া সরকার আজ চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে!

মানিক মিয়া সরকার বিটিভির মহাবিখ্যাত কিছু নাট্যপ্রযোজনার নেপথ্যে অন্যতম চিত্রগ্রাহক হিশেবে ক্যামেরা চালিয়েছেন অপরূপ দক্ষতায়। কয়েকটা উদাহরণ দিলে পাঠকের চোখের সামনে ভেসে উঠবে তাঁর মেধার দীপ্তি। মুস্তাফা মনোয়ারের ‘রক্তকরবী’, মোস্তাফিজুর রহমানের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আতিকুল হক চৌধুরীর ‘বাবার কলম কোথায়’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘বরফ গলা নদী’, কিংবা নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘ভাঙনের শব্দশুনি’সহ বিটিভির আরো কিছু সংখ্যক কালোত্তীর্ণ নাট্যপ্রযোজনার অন্যতম কুশলীচিত্রগ্রাহক হিশেবে মানিক মিয়া সরকার আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।

মানিক ভাই,আমি দেশান্তরি হবার বহু বছর পর ২০১৫/১৬ সালের এক সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাবে আপনার সঙ্গে সহসা আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে অপরূপ হাসিতে উচ্ছ্বল আপনি চিৎকার করে উঠেছিলেন–‘আরে লিটল্‌ তুমি!’

প্রিয় মানিক ভাই, আজকে আপনার অনন্তযাত্রাকালে আপনার স্নেহধন্য লিটল্‌-এর অশ্রুসিক্ত ভালোবাসা আপনার জন্যে।

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent