বুধবার - এপ্রিল ২৪ - ২০২৪

বাঁধের জলে মানিক জ্বলে

ড্যানিয়েল জনসন কুইবেকের বিদ্যুৎ সম্পদের অন্যতম স্রষ্টা

সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রবল প্রতাপে টিকে আছে তখনো। বিশ্বব্যাপী নির্লজ্জ যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মারণাস্ত্রের দাপট প্রদর্শনে ব্যস্ত দুই মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন। সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। তরুণ সমাজে মুখে মুখে আবৃত্তি চলছে। এখন যৌবন যাঁর যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়। ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। লোড শেডিংএ আবৃত কৃত্রিম অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অন্ধকার দানব লোড শেডিং নিকোষ কালো থাবায় ঢেকে রেখেছে গোটা তৃতীয় বিশ্ব। দুই মোড়লের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে উন্নয়নের সিঁড়ি টপকাচ্ছে পশ্চিম জার্মান, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া’সহ কয়েকটি দেশ। শিল্প বাণিজ্যে তর তর করে এগিয়ে চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জন করেছে। বিদ্যুতের আলোর বন্যায় ভেসে চলছে ওদের শহর, বন্দর, গঞ্জ, গ্রাম।

বাংলাদেশ সহ পল্লী বিদ্যুতের লো-ভোল্টেজের আলোয় টিম টিম করে যখন জ্বলছে বিশ্ব তখন কানাডা তার একমাত্র প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ করছে বিদ্যুৎ। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্ব সীমান্তের সাতটি স্টেট কুইবেক থেকে বিদ্যুৎ আমদানী করে। এখনো করছে। কানাডার সর্বমোট উৎপাদনের ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। ৩৪টি ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সমিশন লাইন বর্তমানে একটিভ রয়েছে।

- Advertisement -

কুইবেকের হাইড্রো ইলেক্ট্রিসিটি জল বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম সেরা। প্রাদেশিক সরকারের সবচে গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হাইড্রো কুইবেক এর উৎপাদক। হাইড্রো কুইবেকের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ম্যানিক বাঁধ। একটু সরল বাংলায় বললে হয়ে যায় মানিক বাঁধ। শুরুতে বাঁধের নাম ছিলো ম্যানিক-৫। পূর্ণ ক্ষমতায় গেট খুলে দিলে গড়িয়ে পড়া পানির তোড়ে ঘুরতে থাকে ১২টি টারবাইন। গড়ে একেকটি টারবাইন ২০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সর্বমোট উৎপাদিত হয় প্রায় ২৭০০ মেগাওয়াট। এই পরিমান বিদ্যুৎ সেই ১৯৭০ সাল থেকেই উৎপাদন করে আসছে মানিক বাঁধ। ৮০ দশকের মাঝামাঝি এসেও বাংলাদেশে আমরা একত্রে ২৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাইনি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাঁধের কাজ শেষ হয় ১৯৭০ সালে এর ভেতর ঘটে যায় এক ট্রাজেডি যে ট্রাজেডির সাথে ম্যানিক বাঁধে মানিক জ্বলা নতুন নামের স্মৃতি জড়িত এ বাঁধের অফিসিয়াল নাম ড্যানিয়েল জনসন বাঁধ পানিসম্পদ মন্ত্রী ড্যানিয়েল জনসনের প্রাণান্তকর চেষ্টায় দ্রুত তৈরী হয় এ বাঁধ নির্মাণ চলাকালীন সময়েই কুইবেকের জনগণ তাকে প্রিমিয়ারের চেয়ারে আসীন করে ১৯৬৬ সালে তিনি কুইবেকের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন প্রিমিয়ার পদে শপথ নেন

ম্যানিক বাঁধের ইতিহাসটা একটু অন্যরকম। তুলনামূলক কম সময়ের পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনায় এ বাঁধ নির্মিত হয়েছিলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এবং এর পরে প্রচুর ইউরোপিয়ান কানাডায় পারি জমায়। বিশেষ করে কুইবেক প্রদেশে। নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে অতি দ্রুত। বিদ্যুতের চাহিদা হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে যায়।

ম্যানিক নামটি এসেছে ম্যানিকুয়াগান নদীর নাম থেকে। মন্ট্রিয়ল শহর থেকে প্রায় পৌনে ৯ শ’ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে এ বাঁধের অবস্থান। ম্যানিকুয়াগান নদী এবং উটারদেস নদীর যৌথ প্রবাহ বীর বিক্রমে প্রবাহিত হচ্ছে এই পয়েন্টে। যৌথ পানির প্রবাহের পরিমাপ ৪০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। ১৯১৯-২০ সালের একটি পানিসম্পদ গবেষণায় এ তথ্য জানা ছিলো সরকারের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ১৯৫৫ সালে হাইড্রো কুইবেক এতবড়  পানিসম্পদ ব্যবহারের জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। আগের গবেষণায় পর্যাপ্ত ডাটা থাকায় হাইড্রো কুইবেকের প্রকৌশলীরা খুব দ্রুতই তাঁদের রিকমেন্ডেশন পেপার সরকারের কাছে সাবমিট করে।

১৯৫৯ সালেই সরকারী বরাদ্দ চলে আসে। মূল নির্মাণ শুরু করার প্রস্তুতি এবার। কুইবেকের প্রিমিয়ার তখন মরিস ডুপ্লেসিস। প্রস্তাব করলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কোনো প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বাঁধের ডিজাইন করাবেন। কিন্তু প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রী ড্যানিয়েল জনসন। কুইবেকের ইতিহাসে সবচে বিচক্ষণ পানি সম্পদ মন্ত্রী তিনি।  বললেন, কানাডিয়ান প্রকৌশলীরা এই বাঁধের গবেষণা করেছে। এর ডিজাইন এবং নির্মাণ তাঁরাই করবে। কেবল কানাডিয়ান নয়, তাঁরা অনেক কুইবেকার-কানাডিয়ান। ডুপ্লেসিসের পছন্দ হলোনা বিষয়টি। প্রকল্প কিছুদিনের জন্য থেকে রইলো। কিন্তু সে বছরই পল সভে নতুন প্রিমিয়ার হলে তিনি ড্যানিয়েল জনসনের প্রস্তাবটি লুফে নেন। দায়িত্ত্ব দেয়া হয় কানাডিয়ান প্রকৌশলীদের।

নির্মাণ শুরু হলো। ১৪টি ব্যাট্রেস এবং ১৩টি আর্চের সমন্বয়ে বিরাট কংক্রিট স্ট্রাকচার। কংক্রিটে লেগেছিলো ২.২ মিলিয়ন মিটার কিউব। যা কিনা ঘনফুট বা সিএফটি মাপে দাঁড়ায় প্রায় ৭ কোটি ৭৭ লক্ষ সিএফটি। বর্তমান মাপের রেডিমিক্স কংক্রিট ট্রাকের সংখ্যা হতো আড়াই লক্ষ ট্রাক। বাঁধের দৈর্ঘ সোয়া ১ কিলোমিটারের উপরে। সঠিক সংখ্যায় ১ হাজার ৩ শত ১৪ মিটার। উচ্চতা মাথা ঘোরার জন্য যথেষ্ট। ২১৪ মিটার। অর্থাৎ ৭০ তলা ভবনের সমান। বাঁধের কারণে আটকানো জলের আয়তন ১৯৫০ বর্গকিলোমিটার। যা কিনা সমগ্র ভুটান দেশটির অর্ধেক।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাঁধের কাজ শেষ হয় ১৯৭০ সালে। এর ভেতর ঘটে যায় এক ট্রাজেডি ,যে ট্রাজেডির সাথে ম্যানিক বাঁধে মানিক জ্বলা নতুন নামের স্মৃতি জড়িত। এ বাঁধের অফিসিয়াল নাম ড্যানিয়েল জনসন বাঁধ। পানিসম্পদ মন্ত্রী ড্যানিয়েল জনসনের প্রাণান্তকর চেষ্টায় দ্রুত তৈরী হয় এ বাঁধ। নির্মাণ চলাকালীন সময়েই কুইবেকের জনগণ তাকে প্রিমিয়ারের চেয়ারে আসীন করে। ১৯৬৬ সালে তিনি কুইবেকের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন প্রিমিয়ার পদে শপথ নেন। ১৯৬৮ সালের যেদিনটিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সেদিনও তিনি এ বাঁধ বিষয়ক মিটিংএ সভাপতিত্ব করছিলেন। বাঁধ কবে উদ্বোধন করবেন সে সিদ্ধান্তের জন্য মিটিং বসেছিলো সেদিন। মৃত্যু তাঁকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে বিরত রাখলেও বাঁধের উদ্বোধন হয়েছিলো ম্যানিক-৫ নামে নয়। ড্যানিয়েল জনসন বাঁধ নামে।

ম্যানিক বাঁধ নামে পরিবর্তিত হলেও মানিক থেকেই যায়। ঝলমলে বিদ্যুতের ঝলসানো আলোয় আলোকিত ড্যানিয়েল জনসনের নামটি। কুইবেকের বিদ্যুৎ সম্পদের অন্যতম স্রষ্টা তিনি। বাঁধের জল থেকে জ্বলে ওঠা এক মানিক।

ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent